Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি মননের কৃষ্ণপক্ষ

মাহমুদুল হাসান

ডিসেম্বর ১৪, ২০২০, ০২:০০ পিএম


 বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি মননের কৃষ্ণপক্ষ

ষাটের দশকের পুরোটা সময় বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। এসব মুক্তিসংগ্রামে মূল রসদ জুগিয়েছে আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন থেকে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত সব আন্দোলনের নেপথ্যে ছিলেন তারা। 

নিজেদের মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন মুক্তির। উদ্দীপ্ত করেছেন অধিকার আদায়ে। সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ালো তাদের জন্য। 

ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল, তখন তাদের প্রথম শিকার হয়েছিলেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীসমাজ। 

আবার নয় মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই আবার বাঙালির কৃতীসন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাক হানাদার আর তাদের এদেশি দোসররা।

বধ্যভূমিতে বড় অসহায় দশায় নিঃশেষে প্রাণ দেন আমাদের সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক ও সংগীতশিল্প তথা বুদ্ধিজীবীরা। এক অর্থে বলা চলে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে।

প্রশ্ন হলো— পাকিস্তানি শাসকরা কেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত মানুষকে কেন তারা লক্ষ্য বস্তু করেছিল এবং চূড়ান্ত পরাজয়ের মুহূর্তে কেন তারা নিজেদের সব জিঘাংসা চরিতার্থ করতে আবারো বেছে নিয়েছিল সেই বুদ্ধিজীবী সমাজকেই?

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মশিউল আলম তার একটি নিবন্ধে এসব প্রশ্নের সুন্দর জবাব দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন— তারা বুঝেছিল, একটা জাতির মনন গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের দেখানো পথ ধরে।

 যে বাঙালি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল, গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল, স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তার চিন্তা ও কল্পনার রূপায়ণে বুদ্ধিজীবীদের গভীর প্রভাব ছিলো। 

১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অবদানে। বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে ফেললে তাদের জাতি গঠনের কাজ দুরূহ হবে।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা আজও নিরূপণ করা যায়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী। ঘাতক-দালাল চক্র এই পৈশাচিক-নির্মম নিধনযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। 

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আত্মীয়-স্বজনরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের লাশ খুঁজে পায়। ঘাতকবাহিনী আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার পর পৈশাচিকভাবে নির্যাতনও করেছিল। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এভাবেই ফুটে ওঠে— “আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটি ছিলো তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটো আজো এখানে পড়ে আছে। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ি ছিলো। এক পায়ে মোজা ছিলো। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। যেন চেনা যায় না। 

মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। দেখার উপায়ও ছিলো না। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সেলিনা পারভীন। ‘শিলালিপি’র এডিটর। তার আত্মীয়রা বিকালে খবর পেয়ে লাশটি তুলে নিয়ে গেছে।”

কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগের একটি খণ্ডচিত্র আঁকা রয়েছে। জন্মসূত্রে বরিশালের সন্তান ও কর্মসূত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত গদ্য রচনায়। এটি আদোতে পনেরো মিনিটের একটি ভাষণ, যুদ্ধ পরিস্থিতি প্রবল হয়ে ওঠার পরপরই আকাশবাণী কলকাতা থেকে সমপ্রচারিত। পরে চতুঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

সেখানে শঙ্খ ঘোষ লিখেন— ‘জসীম উদ্দীন থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত কবিরা এখন কোথায়, এই মুহূর্তে? ইয়াহিয়ার সৈন্যরা নাকি গুড়িয়ে দিয়েছে ইত্তেফাকের অফিস, ধ্বংস করেছে তার সাংবাদিক কর্মীদের? তা হলে আল মাহমুদ কোথায়? কোথায় এখন তিনি? বোমায় বিধ্বস্ত রংপুর। কায়সুল হক? ঢাকার জসীমউদ্দীন রোডেও কি ঢুকেছিলো ইয়াহিয়ার ট্যাংক?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ পনেরো দিনের পুরোনো হলো, এর মধ্যে আমরা জেনেছি কীভাবে সামরিক অত্যাচার প্রথমেই ছুটে যাচ্ছে যেকোনো বুদ্ধিজীবীর দিকে। ইয়াহিয়ার দল ঠিকই বুঝতে পারে যে, এইখান থেকেই জেগে উঠেছে অবিশ্বাস্য এই মুক্তিবাসনার প্রথম আগুন।’

পৃথিবীতে এর আগে একসাথে এত বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা আর ঘটেনি। তাই ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা। যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। 

ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে উৎকীর্ণ বেদনাবিধুর কালবেলা। তাই বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল বাঙালির কণ্ঠে আজও উচ্চারিত হয়— 

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে, 
ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই...।’
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দুদিনের মাথায়ই মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়বরণ করে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করতে হয় মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে। বীর বাঙালি দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে ত্রিশ লাখ শহিদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। পৃথিবীর মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নেয় শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের পথে দেশ। গোটা জাতি ও শহিদদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং স্বজনরা আশায় বুক বেঁধেছে, ঘৃণ্য নরপশু সব বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার হবে। ঘৃণ্য হত্যাকারীদের প্রত্যেকের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কের হাত থেকে মুক্তি পাবে। 

স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান জাতির সূর্য সন্তান হন্তারকদের বিচার চেয়ে লিখেছিলেন—
‘না আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই, তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিল সেঁটে...

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক আমার সংবাদ
সভাপতি, ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি

আমারসংবাদ/এআই