Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ইরাবতী ডলফিন রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে

সুরেশ কুমার দাশ

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


ইরাবতী ডলফিন রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে

মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, মমত্ব ও বুদ্ধিমত্তায় অনন্য প্রাণী ডলফিন। বলা হয়, হাজার বছর ধরে অকূল সাগরে দিকহারা নাবিককে দিশা দিয়ে আসছে ডলফিন। সাগরে বিপদে পড়া অভিযাত্রী কিংবা নাবিকরা যখন সাগরে ডলফিনকে লাফিয়ে উঠতে দেখেন— তখন জেলে, মাঝি, নাবিক ও যাত্রীরা ভরসা পান এই ভেবে যে, কাছাকাছি কোথাও কূলের দেখা মিলবে। তখন জেলে-মাঝির সাহস ফিরে আসে।

কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা অন্য প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার সেই প্রতিদান দিতে পারিনি। সেই ভাবনা আমাদের মাঝে নেই। এই কৃতজ্ঞতাও মানুষের নেই যে, সহাবস্থানই আমাদের টিকে থাকার অবলম্বন। মানুষের অনেক অজুহাত  অবলা-অবুঝ প্রাণী হত্যায়, তাদের প্রতি নির্মমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে।

যে কারণে জলে-স্থলে কোনো পরিবেশেই প্রাণীরা নিরাপদ নয়। দিনের পর দিন বিলুপ্ত হচ্ছে নানা ধরনের প্রাণী। বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিন এখন এরকম একটি প্রাণী, যেটি অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে। বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন এলাকায় ইরাবতী ডলফিনের বসবাস। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় একের পর এক ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে।

প্রায় এক মাসে চারটি ডলফিন মারা গেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সাগর উপকূলে। এ যেন ডলফিনের মৃত্যুর মিছিল চলছে। সপ্তাহ-মাসের ব্যবধান নয়, দিনের পর দিন সাগর, নদী কোথাও না কোথাও মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হচ্ছে। কিন্তু ডলফিন রক্ষায় কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই কোনো কর্তৃপক্ষের।গত ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডের মান্দারিটোলার সাগর উপকূলে তিনটি মৃত ইরাবতী ডলফিন উদ্ধার করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার বিকালে মান্দারিটোলার উপকূলে মৃত ডলফিন তিনটি ভেসে আসে। পরদিন বুধবার ওই ডলফিনগুলোর পচা দুর্গন্ধ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর মানুষ জানতে পারে। স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা, ডলফিনগুলো জালে আটকা পড়ে মারা গেছে।

গত ২০ অগাস্ট সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুরের বগাচত্বর উপকূলের সংরক্ষিত বন থেকে আরও একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করেছিলেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ, এক মাস না যেতেই সীতাকুণ্ড উপকূল থেকে চারটি মৃত ইরাবতী ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের হামিদচর থেকে ১ আগস্ট একটি মৃত ডলফিন উদ্ধারের খবর পত্রিকায় আসে। শুধু সীতাকুণ্ড নয়, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, সীতাকুণ্ড ও আনোয়ারা উপকূলে গত এক মাসে ১৪টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। রংপুরে তিস্তা নদীতেও ৩ মণ ওজনের মৃত ডলফিন ভেসে আসার খবর ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল।

এছাড়া হালদা নদীও ডলফিনের বসবাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সাগর ছাড়াও গত ৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মেখল ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের চানখালী খালের ব্রিজের কাছ থেকে একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধারকারীরা এটির মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মনে করেছেন; কারণ এটির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। পরে এটির পাখনা কেটে গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা গবেষণাগারে পাঠানো হয়।

শুধু হালদা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত ২৯টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো কিছু আঘাতে, আর কিছু জালে আটকা পড়ে মারা গেছে বলে গবেষকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন। এদের মধ্যে ৩টি ডলফিন জালে আটকা পড়ে মারা গিয়েছিল। ৭টির গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। একটি চর্বি চুরির জন্য হত্যা করা হয়েছিল। বাকি ডলফিনগুলো নৌযানের ধাক্কায় মারা গেছে।

মূলত বন্যপ্রাণী কর্মকর্তা ও গবেষকদের পর্যবেক্ষণ এগুলো। তাহলে ডলফিন মারা যাওয়ার আরও বহু কারণ আছে। হালদা নদীতে জালে আটকা পড়ে মারা যাওয়া, জলযান বা বালি তোলার ড্রেজার মেশিনের আঘাতে মারা যাওয়ার কারণই জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রামের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সাধারণত জেলেদের জালে আটকা পড়ে ডলফিন মারা যায়। ডলফিনের চলাচলের পথ জালমুক্ত রাখতে হবে। এজন্য সাগরে টহল বাড়াতে হবে। কিন্তু বন বিভাগের জনবল পর্যাপ্ত নয়।

এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে একটি বিষয় পরিষ্কার— এ বছর বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ করতে পারেনি জেলেরা। বছরের এই মৌসুমে সাগর থেকে সবচেয়ে বেশি মাছ আহরণ করা হয়। এ বছর কিন্তু তার ১০ শতাংশ মাছও বাজারে দেখা যায়নি। শুধু ইলিশই নয়, অন্য মাছও আহরণ করা হয়। এই মাছ না পাওয়াটাই কাল হয়েছে ডলফিনের জন্য। সীতাকুণ্ড উপকূলে একের পর এক ডলফিন মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে এটাই প্রধান। জেলেরা মাছ পাওয়ার জন্য মরিয়া।

সেজন্য কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সাগরে জাল ফেলছে তারা। একে তো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে যেখানে-সেখানে জাল ফেলায় সাগরের অন্যান্য প্রাণীর বিচরণস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ডলফিনগুলো জেলেদের তোপের মুখে পড়েছে।

সাধারণত জাল দিয়ে মাছ ধরা বাড়লে নৌযানও বাড়বে। ডলফিন শুধু জালেই আটকা পড়ছে তা নয়, এর সাথে জলযানের সাথে আঘাত পাওয়ার বিষয়ও আছে। অন্যদিকে হালদায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা হয়, সেদিক থেকেও হালদায় ডলফিনগুলো তাদের বিচরণে বাধার শিকার হচ্ছে। আর যন্ত্রের আঘাতে আহত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে।

সাধারণত মানুষের বিচরণের স্থানগুলোতে ঘোরাফেরা করাই ডলফিনের একটা বৈশিষ্ট্য। ওরা দল বেঁধে ঘোরে। দলে ৬ থেকে ১৫টির বেশি ডলফিন থাকতে পারে। দল বেঁধে ঘোরার কারণে এক সঙ্গে ২-৩টি ডলফিনও মারা যাচ্ছে।

২০০৩ সালে নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি ও বাংলাদেশ কেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট বাংলাদেশের পানিসম্পদ গবেষণা করতে গিয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এবং মোহনা এলাকায় ৫ হাজার ৮৩২টি ইরাবতী ডলফিন থাকার কথা বলেছিল। তাদের সেই গবেষণায় বলা হয়েছিল— বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরার কাজে লম্বা জাল ব্যবহার করেন।

এসব জালে প্রায়ই ডলফিন আটকা পড়ে শেষ পর্যন্ত মারা যায়। এ ছাড়া তেল ও মাংস পাওয়ার জন্যও ইরাবতী ডলফিন হত্যা করা হয় বলে গবেষকরা জানিয়েছিলেন। তখন তারা বাংলাদেশ সরকারকে ইরাবতী ডলফিনের বিলুপ্তি ঠেকানোর জন্য সতর্ক করেছিলেন।

আইইউসিএন এ প্রজাতির ডলফিনকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকাভুক্ত করেছে। প্রায় ৬ ফুট দীর্ঘ এই ডলফিন লোনা ও মিঠা উভয় পরিবেশেই বাঁচতে সক্ষম। এর আগে এই ডলফিন খুব অল্প সংখ্যায় অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ফিলিপাইনে দেখা গিয়েছিল।

 অর্থাৎ পৃথিবীতে বাংলাদেশের ইরাবতী ডলফিনগুলোর সংখ্যাটাই সর্বোচ্চ। তারা বাংলাদেশের ১৪০০ কিমি উপকূল এলাকায় দীর্ঘ সময় গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছিল। ইরাবতী ডলফিন মেকং নদীর মোহনায়ও আছে; তবে তা ১০০-এর বেশি নয়। সুতরাং ইরাবতী ডলফিন যা আছে, তা বাংলাদেশেই। বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিন পাওয়ার আগে মনে করা হতো এসব ডলফিন বিপন্ন হয়ে গেছে।

ভারত সরকার গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী ঘোষণা করেছে। আর ইরাবতী ডলফিন তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অসতর্কতা ও অবহেলায় বিপন্ন হতে চলেছে। নির্দয়ভাবে মরছে। যে প্রাণীটি দুবছরে একবার বাচ্চা দিতে সক্ষম, সেটি যদি এক মাসে ১৪টি মারা যায়, তবে তাকে রক্ষা করা কীভাবে সম্ভব? এজন্য বন্যপ্রাণী ও গাছের জন্য যেমন রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়া থাকে, তেমনি ইরাবতী ডলফিনের জন্য রিজার্ভ ওয়াটার এরিয়া ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যদিকে জেলেদের সতর্ক করা, সঠিক জলপথ নির্ধারণ, নদী থেকে বালু উত্তোলনসহ নানা পরিবেশবিরোধী অপকর্ম রুখতে হবে। এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগ করে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিনের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। সাগরে নাকি ডলফিন বর্ম তৈরি করে জেলে-নাবিকদের বাঁচাতে সহায়তা করে। সমুদ্রচারী ডুবন্ত নাবিকদের নিজের পিঠে তুলে তীরে পৌঁছে দেয়ার কথা-কাহিনিও শোনা যায়। আবার ক্ষোভে-দুঃখে এরা নাকি আত্মহত্যাও করে! আর আমাদের আত্মহত্যা ঠেকাতে হলে প্রাণী ও পরিবেশের প্রতি সদয় হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট