Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ ফারুক হোসেন

অক্টোবর ১০, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ অতিমারিতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পুরো বিশ্ব। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে বিশ্বের সব মানুষ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

১৯৬০ সাল থেকে শতাধিক বিপর্যয়ের জেরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের এ বিশ্ব। নিঃস্ব হয়েছে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। আর অধিকাংশ বিপর্যয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন।

২০২০ সালে আবহাওয়ার অবনতি ও জলবায়ুর পরিবর্তনগত কারণে ঘরছাড়া হয়েছে চার কোটি মানুষ। একই সঙ্গে এ বছর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরো চরম হচ্ছে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব। চলতি বছরের মধ্যে তা রেকর্ড ভেঙে সাড়ে পাঁচ কোটিতে দাঁড়াবে। এর ফলে বহু মানুষকে ছাড়তে হবে নিজ দেশ। এই সংখ্যা বর্তমান বিশ্বের শরণার্থী জনসংখ্যার দ্বিগুণ।

বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে সমগ্র বিশ্বের মানুষ। বিশেষত গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা মহাদেশেও। জীবাশ্ম জ্বালানির বাড়ন্ত ব্যবহার আবহাওয়াকে উষ্ণ করে তুলছে; এর ফলে আরো বেশিসংখ্যক মানুষ অপ্রত্যাশিত বন্যা বা ঝড়ের কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হবে।

পাশাপাশি ফসলের ক্ষতি ও খরার মতো কারণও এই ধারাকে আরো প্রকট করে তুলছে। ধনী দেশগুলোর রাজনীতিকরা অন্যান্য দেশ থেকে পরিবেশ শরণার্থীদের আসার কারণে তাদের দেশের অবকাঠামোর ওপর বাড়তি চাপের আশঙ্কা করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে কার্বন নিঃসরণ। কার্বন নিঃসরণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিম্ন আয়ভুক্ত দেশগুলো প্রতিশ্রুত ফি-বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত।

এশিয়ায় পরিবেশগত কারণে উৎখাত হওয়া মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে লাখ লাখ মানুষ নিচু তটবর্তী অঞ্চলে বা বদ্বীপ-সংলগ্ন এলাকায় থাকে। সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে আরো বেশি করে মানুষ বন্যাঝুঁকিতে রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ দ্রুতগতিতে বাড়ার দিকটিও।

ইতোমধ্যে চরম আবহাওয়া, খরা বা অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী হয়েছে মানুষ। অর্থাৎ, ধীরে ধীরে জলবায়ু তথা প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক রূপটি প্রকট হচ্ছে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের জন্য মনুষ্যসৃষ্টি অনেক কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির ওপর নানাভাবে খবরদারি করছে। খালবিল, নদীনালা দখল করা হচ্ছে। পাহাড় কাটা চলছে নির্বিচারে। কৃষিজমির ওপর নির্মিত হচ্ছে ঘরবাড়ি।

এভাবে নানাভাবেই চলছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার, যে কারণে প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠছে। আমরা নিজেরাই নষ্ট করছি নিজেদের সব অর্জন। ফলে দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড দাবদাহ। প্রকৃতিতে কেন এত তাপদাহ। বিশ্বের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।

নতুন আর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় কিংবা কীভাবে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনা যায়— এসব আরো একবার হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন সমস্যা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস ও অপুষ্টির কারণে।

এছাড়া সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, ওজোনস্তর ধ্বংসসহ বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার ওপর যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও কোভিড-১৯। তার মূলেও রয়েছে এই জনসংখা বৃদ্ধি। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়েছে। এক গবেষণায় ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ২৫টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার নাম দেয়া হয়েছে ‘হিট আইল্যান্ড’। এসব এলাকার লোকজনের নানাবিধ রোগব্যাধি বৃদ্ধিসহ কর্মক্ষমতা দিন দিন কমছে।

মহামারি ও দুর্যোগের দ্বৈত বিপদ মোকাবিলায় বিশেষ করে জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগের বর্ধিত পৌনঃপুনিকতা আক্রান্ত সিভিএফ দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রয়োজন। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে সবচেয়ে কম অবদান রাখে; কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসায় ২০২১ সাল জলবায়ু ইস্যুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। আগামী নভেম্বরে স্কটল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় জলবায়ুবিষয়ক কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বেশ কিছু ভালো ফল আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। ‘কপ-২৬’-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং জনগণকে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করা। বাংলাদেশও এই জলবায়ু পরিবর্তন রোধ প্রকল্পে শরিক হয়েছে।

প্রাচীনকালে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। মানুষ যখন থেকে সভ্যতার সংস্পর্শে আসে, তখন থেকেই প্রকৃতির ওপর আঘাত হানতে শেখে। কালক্রমে প্রকৃতির ওপর মানুষ ধ্বংসাত্মক কাজ চালাতে শুরু করে। দিনদিন বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা। নিষ্ঠুরতার শিকার থেকে বাদ যায়নি বৃক্ষরাজিও।

ফলে আমাদের বসবাসযোগ্য পৃথিবীর মাঝে প্রতিনিয়ত শঙ্কা ঘনীভূত হয়ে আসে। আমরা তা থেকে পরিত্রাণের আশায় বিভিন্ন পথ খুঁজে বেড়াই। অথচ প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দিলে আমাদের জীবদ্দশায় এই পরিণাম ভোগ করতে হতো না। মানুষ গতির মোহে অন্ধ হয়ে বন-জঙ্গল কেটে কখনো বসতবাড়ি স্থাপন, কখনো সেখানকার জীবজন্তুকে বিতাড়ন করেছে ও করছে।

সাম্প্রতিক সময়েও কোথাও পাহাড় কাটা, কোথাও বন উজাড় করা হচ্ছে। বৃক্ষচ্ছেদন ও অরণ্যের ওপর অত্যাচার অনেক মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। এমনকি এর ফলে ঋতুচক্রেরও বদল ঘটছে। এসব ঘটনা আমাদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দেয়।

অথচ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে গাছ হতে পারে মোক্ষম প্রতিরোধক। পরিবেশ না বাঁচলে পৃথিবীর সমস্যা ঘনীভূত হবে। জীবজন্তু, মনুষ্যকুল সর্বস্ব ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মানুষের উদাসীনতাই হবে এর মূল কারণ। আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এই উদাসীনতার পেছনে নীতিভ্রষ্ট বাজার অর্থনীতির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। নদী, পাহাড়, মৃত্তিকা, অরণ্য সবই সেই বাজারের দৃষ্টিতে আয় বৃদ্ধির উপকরণ।

এসব উৎস থেকে আয় করতে গিয়ে বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণ হারাচ্ছে শতবর্ষী পুরোনো গাছ কিংবা বিপন্ন হচ্ছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার। আগেকার সময়ে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা মেলবন্ধন ছিলো, যে কারণে গাছপালার কোনো ক্ষতিসাধন না করে প্রয়োজনীয় কাজ করার উপায় খুঁজে বের করে এখনো যারা গাছগাছালির সংস্পর্শে থেকে বেড়ে ওঠে, তারা প্রকৃতির সংস্পর্শকে উপলব্ধি করতে পারে বলেই অনেক জায়গায় বন-জঙ্গল টিকে আছে।

সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে তৎপরতার সঙ্গে লড়তে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ রেখে যেতে সার্বিক বৈশ্বিক উদ্যোগসহ জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে বিশ্বনেতাদের। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে তাদের অভিযোজন ও প্রশমন প্রচেষ্টায় সহায়তা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়