Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

ইয়াহিয়া নয়ন

অক্টোবর ২২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। এ মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক লোকজন। যৌনতা, জঙ্গি, ধর্মান্ধ, চোরাকারবারি থেকে শুরু করে ই-কমার্সের এক শ্রেণির ধান্ধাবাজও ঢুকে পড়েছে। ই-কমার্সের কথাই বলি, করোনার সময়ে বেড়েছে ই-কমার্সের ব্যাপ্তি। বিশেষ করে ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্সের প্রসার ঘটেছে বেশি। 

ঘরবন্দি মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে শুধু পণ্য নয়, খাবারও অর্ডার দিয়েছে অনলাইন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। দ্রুত পৌঁছে গেছে তাদের অর্ডারকৃত পণ্যটিও। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য বুঝিয়ে না দেয়ার অভিযোগও ওঠে। সঠিক সময়ে পণ্য বুঝিয়ে না দেয়া এবং টাকা ফেরতের বিষয়ে তালবাহানার কারণে একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা পলাতক আছেন, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ঢাকায় প্রায় ৬৫০টি ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন শপিংয়ের পেজ চালু আছে। আর বাকি ১৫০টি ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর ও জেলায় চালু আছে। পুলিশ বলছে, যারা ফেসবুকভিত্তিক ই-অনলাইনে শপিংয়ে প্রতারণার শিকার হবেন, তারা যাতে থানায় গিয়ে মামলা করেন। তাহলে প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা যাবে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। এতে প্রতারকরা দ্রুত আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার সরব হচ্ছে।

সিআইডির সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ই-কমার্স ব্যবসার দ্রুত প্রচার ঘটেছে। প্রায় ৮০০ প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ ঘরে বসেই সব পণ্য পাচ্ছে। কিন্তু এতোগুলো প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে সব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে পুলিশের সাইবার ইউনিট আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। কারণ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা নয়-ছয় করতে দেখা গেছে। পরে গ্রাহকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির সিও মো. রাসেলসহ তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।

এ তো গেল বাণিজ্য। ‘ফেক নিউজ’ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগের এক জটিল সমস্যা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই এখন এ বিষয়টি মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। কক্সবাজারের রামুতে হঠাৎ শোনা গেলো সেখানকার একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে উত্তম বড়ুয়া নামে কোনো এক বৌদ্ধ তরুণের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্ম, ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবমাননা করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটলেও সেই আইডির আসল ব্যক্তিকে আর পাওয়া যায়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে নাসিরনগর। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবরের কথা। সেখানে সেদিন যে হামলাটি হয়েছিলো, তাও ঘটেছিলো একই কায়দায়, একই কারণে। ফেসবুকে কথিত একটি ইসলামবিদ্বেষী ছবি পোস্ট করার অভিযোগে নাসিরনগরে হিন্দুদের অন্তত ৫টি মন্দির ও বহু বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছিলো। আর এ ঘটনায় সামনে এসেছিলো রসরাজ নামের এক ব্যক্তির নাম।

নাসিরনগর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হরিপুর গ্রামের এক হিন্দু যুবক রসরাজ দাস। তার নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে যে ছবি প্রকাশের অভিযোগ উঠেছিলো, তা সেখানকার গ্রামবাসীকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। অভিযোগ ছিল, মুসলমানদের কাবা ঘরের সঙ্গে হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি ছবি জুড়ে দিয়েছিলেন রসরাজ। স্থানীয়রা সেদিনই রসরাজ দাসকে ধরে পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছিলো। তার বিরুদ্ধে পরদিনই মামলা করে তাকে চালানও দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তবুও থেমে যায়নি বিষয়টি। 

সেদিন একাধিক স্থানীয় ইসলামপন্থি সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করেছিলো। হঠাৎ করেই ক্ষুব্ধ জনতা যেন সংঘবদ্ধ হয়ে উঠলো এবং নাসিনগরের হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করা শুরু করলো।প্রথম দিনই আটটি হিন্দুপাড়ায় অন্তত ৩০০ বাড়িঘর, মন্দির, দেবদেবীর মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর হয় রসরাজের বাড়িও। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে আরেক দফা হামলা হয় নাসিরনগরের হিন্দুদের ওপর।

ঘটনার আড়াই মাস পর জামিনে বের হয়েছিলেন পেশায় জেলে রসরাজ। বের হয়ে তিনি বলেছিলেন, তিনি ফেসবুক চালাতে জানেন না। পাসওয়ার্ড কাকে বলে— সে নিয়েও তার কোনো ধারণা নেই। যে পোস্টটিকে ঘিরে এত ঘটনা, সেটিও পরে আর পাওয়া যায়নি।

নাসিরনগরে হামলার ঠিক এক বছরের মাথায় ২০১৭ সালের নভেম্বরের ১০ তারিখে রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঘটনাটি গড়িয়েছিল গুলি ও একজনের মৃত্যু পর্যন্ত। আবারো ফেসবুকের ছড়ানো খবরই এ ঘটনার সূত্রপাত। আর এক্ষেত্রেও এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক থেকে ইসলামের নবী (সা.)-কে অবমাননার অভিযোগে স্থানীয়ভাবে ক্ষোভ থেকে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছিলো।

সে সময় পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, টিটু রায় নামে যে ব্যক্তির ফেসবুক পোস্ট ঘিরে এ ঘটনা, সেই টিটু রায়ের বাড়ি গঙ্গাচড়ায় হলেও তিনি নারায়ণগঞ্জে বসবাস করেন। ঘটনার দিন এক মানববন্ধন শেষে হঠাৎ করে আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। তারপর মিছিল আকারে হিন্দুপাড়ায় গিয়ে হামলা করা হয়েছিলো। পুলিশের গুলিতে সেদিন একজন নিহত হন। ওই টিটু রায়ের বিরুদ্ধে সে সময় যে মামলাটি করা হয়, সেটিতে চার্জশিট দেয়ার পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। পরে জানা গেলো, সেই টিটু রায় ফেসবুক সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার সমর্থক। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে বেশ ক’জন ব্লগারের বিরুদ্ধে কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেদিন তাদের ঢাকা অবরোধ ছিলো। ভোর থেকে ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা। এক পর্যায়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলেন হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক।

সেদিন শাপলা চত্বর রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিলো। পরদিন ভোর নাগাদ পুরো মতিঝিল এলাকাকে মনে হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অঞ্চল। রাতের বেলায় হাজার হাজার র্যাব, পুলিশ, বিজিবির মিলিত অভিযানে খালি করে ফেলা হয়েছিলো শাপলা চত্বর।

৫ মে হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী, মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু ওইদিন দিবাগত রাতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো পুলিশি অভিযানে মৃতের সংখ্যা আসলে কত ছিলো, তা নিয়ে সে সময় নানারকম দাবি উঠেছিলো। ছড়িয়েছিল নানা ধরনের খবর। সারা রাতজুড়ে নানা ধরনের ফেসবুক পোস্ট চোখে পড়ছিলো। তখন ফেসবুকে আড়াই হাজারের মতো মানুষ নিহত হওয়ার খবর দাবি করা হয়েছিলো। ‘শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডি’ বলে নানা রকম খবর বের হয়েছিলো রাতজুড়ে। কিন্তু অভিযানের পর সেখানে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা জানিয়েছিলেন, বড় আকারে হতাহতের ঘটনা তারা দেখেননি।

তখন ফেসবুকে নানা খবরে গণহত্যার দাবি তোলা হচ্ছিলো। ট্রাকে করে মরদেহ গুম করার অভিযোগও উঠেছিলো। সেই সাথে নানারকম ছবিও ছড়িয়েছিলো ফেসবুকে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ের শেষে ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা; এরপর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে এক মন্ত্রীর করা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ঢাকার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কিশোরদের আন্দোলনে রীতিমতো বিব্রত হয়ে উঠেছিলো সরকার। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী কিশোর-কিশোরীরা হামলার শিকারও হয়েছিল। শেষদিকে এসে ফেসবুকে এ আন্দোলন ঘিরে নানা খবর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো।

পিস্তল হাতে যুবকরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করছে— সেই ছবি যেমন ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তেমনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মেরে ফেলা হচ্ছে, ছাত্রীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে— এমন দাবি করা কিছু ফেসবুক পোস্টও ফেসবুক লাইভ ভাইরাল হয়েছে। তখন আলোচিত হয়েছিলো মডেল ও অভিনেত্রী নওশাবার গ্রেপ্তার। ছাত্ররা যেদিন হামলার শিকার হয়েছিলো, নওশাবা সেদিনই ফেসবুকে একটি লাইভ করেছিলেন। যাতে তিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের মৃত্যু ও এক ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। সে সময় গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন বহু ফেইক আইডি শনাক্ত করে সরকারের পক্ষ থেকে সেগুলো থেকে গুজব ছড়ানোর দাবি করা হয়েছিল।

লেখক : সাংবাদিক