Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

পায়রা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সম্ভাবনার প্রবেশদ্বার

মো. জিল্লুর রহমান

অক্টোবর ২৫, ২০২১, ০৯:৫০ পিএম


পায়রা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সম্ভাবনার প্রবেশদ্বার

বহুল প্রতীক্ষিত পায়রা সেতু অবশেষে গত ২৪ অক্টোবর ২০২১ সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে। পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা সেতুর কাজ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের চূড়ান্ত রূপের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসী। সাগরকন্যা কুয়াকাটার পর্যটন সম্ভাবনা মাথায় রেখে সেতুটি নান্দনিক রূপে গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের সর্ব দক্ষিণের সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এবং বাংলাদেশের তৃতীয় পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। 

পায়রা নদীর উপর নির্মিত ১.৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি দক্ষিণবঙ্গের মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়ন এবং এটি খুলে দেবে যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। বর্তমান সরকার সারা দেশের সঙ্গে অবহেলিত জনপদ দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে এক হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৯.৭৬ মিটার প্রস্থের পায়রা নদীর উপর লেবুখালিতে সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয়। 

এতদিন পায়রা নদী সড়ক যোগাযোগে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হতো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানে সেতু নির্মাণের জন্য নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর সরকার গঠনের পরপরই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। 

২০১১ সালে কুয়েত সরকারের সাথে সেতু নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ শেখ হাসিনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়েই মূলত এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নির্মাণকাজের সূচনা হয় এবং তারই হাতে ২৪ অক্টোবর সেটি উদ্বোধন হয়। পায়রা সেতু প্রকল্পের তথ্য মতে, শুরু থেকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সেতুর নির্মাণকাজ তদারকি করা হয়েছে। যদিও কাজ শুরুর পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারিগরি জটিলতা দেখা দেয়। 

এতে সেতুর কাজ কিছুটা পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাসের কারণে আবারো কাজে বিঘ্ন ঘটে। করোনার প্রকোপ কাটিয়ে ওঠার পর কাজে গতি আসে। সেতুর নির্মাণ কাজের প্রায় ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং উদ্বোধনের আগেই সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হবে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত নদী শাসনের ৮৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হতে আরও দুই মাস সময় লাগবে। তবে, এতে সেতুটি চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না।

পটুয়াখালী জেলাটি বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী সর্ব দক্ষিণের স্থান এবং এখন উন্নয়নের প্রবেশদ্বার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানেই তৈরি হয়েছে দেশের তৃতীয় পায়রা সমুদ্রবন্দর। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বড় পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখানেই তৈরি হচ্ছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ইতোমধ্যেই উৎপাদনে এসেছে। দ্বিতীয় ইউনিট অল্প সময়ের মধ্যেই উৎপাদনে যাবে। এ ছাড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর সমুদ্র সৈকত সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যটনের অন্যতম স্থান। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় পর্যটকরা কুয়াকাটায় যেতে ভোগান্তিতে পড়তেন। পায়রা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের যেকোনো স্থান থেকে সর্বদক্ষিণ উপকূলের সাথে সড়ক যোগাযোগ সহজ হবে। সড়ক পথের যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না।

এই সেতুটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতুর আদলেই তৈরি করা হয়েছে। শক্তিশালী ক্যাবলের মাধ্যমে সেতুর দুই পাশে সংযুক্ত। এর ফলে নদীর মাঝখানে মাত্র একটি পিলার রয়েছে। চার লেন বিশিষ্ট সেতুটির দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪৭০ মিটার ও প্রস্থ ১৯.৭৬ মিটার। সেতুটি ভূমিকম্প সহনীয় এবং সেতুটিতে রয়েছে ৩২টি স্প্যান আর ৩১টি পিলার। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লনজিংয়াল ব্রিজ অ্যান্ড রোড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ব্রিজটি নির্মাণ করেছে। সেতুটি নির্মাণে এক হাজার ৪৪৭.২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। 

বাংলাদেশ সরকার, কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট— এই প্রকল্পে যৌথভাবে পুরো টাকার যোগান দিয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৩৬৮.২৯ কোটি টাকা সরকারের এবং কুয়েতের এক হাজার ৭৮.৯৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই পুরো প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ এবং শুধু মূল সেতুর ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। খুব শিগগিরই বাকি কাজ শেষ হবে বলে প্রকৌশলীরা ধারণা করছেন। সেতুর নির্মাণকাজের পাশাপাশি খরস্রোতা পায়রা নদী শাসন ও তীর সংরক্ষণের কাজও শেষ পর্যায়ে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এক হাজার ৪৪৭.২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা প্রাথমিক মূল ব্যয়ের চেয়ে সাড়ে তিনগুণ বেশি। এ ছাড়া, প্রকল্পটি শেষ করতে নির্ধারিত সময়সীমার চেয়ে পাঁচ বছর বেশি সময় লেগেছে। মূলত প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দুর্বলতার ফলে সেতুর নকশায় বড় ধরনের পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, দীর্ঘ টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং সামপ্রতিক কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণে সেতুটির জন্য হাজার হাজার মানুষকে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রকল্পটিতে যৌথভাবে সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্থায়ন করেছে।

বরিশাল শহর থেকে পটুয়াখালী সদরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার, পায়রা বন্দরের দূরত্ব ৫০  কিলোমিটার এবং কুয়াকাটার দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। বর্তমান সরকার গত কয়েক বছরে বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে বেশ কয়েকটি সেতু নির্মাণ করেছে। কিন্তু, মানুষকে ফেরি দিয়ে পায়রা নদী পার হতে হয়। এতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই সেতু চালু হয়ে গেলে মানুষ বরিশাল শহর থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে পটুয়াখালী জেলা সদর এবং দুই ঘণ্টায় নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দরে যেতে পারবে। আর মাত্র আড়াই ঘণ্টায় জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায়ও যেতে পারবে তারা। এদিকে, দ্রুত এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ছয় ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে, খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

পায়রা সেতুর নির্মাণ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সাথে সারা দেশের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগে একধাপ এগিয়ে যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম একদিকে যেমন বাড়বে, তেমনি পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাকে ঘিরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের উৎপাদিত দ্রব্যাদি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সহজতর হবে। যা এ অঞ্চলের জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে, খুলে দেবে সম্ভাবনার নতুন প্রবেশদ্বার। 

এদিকে সরকারের পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষের পথে রয়েছে। পায়রা সেতু চালুর মাধ্যমে বন্দর থেকে খালাসকৃত যেকোনো পণ্য খুবই কম সময়ের মধ্যে সারা দেশে পরিবহন করা যাবে। পায়রা সেতুর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হবে, পাশাপাশি এ অঞ্চলে নতুন নতুন বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হবে। পাশাপশি জাতীয় অর্থনীতিতে সাফল্যজনক ভূমিকা রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।

সরকার ২০১২ সালের মে মাসে বরিশাল কুয়াকাটা মহাসড়কে সেতু নির্মাণের প্রকল্পে অনুমোদন দেয়। ২০১২ সালের মে মাসে প্রকল্পটির অনুমোদন করা হলেও, সেতুর ভৌত কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। অনুমোদিত নকশা অনুসারে পায়রা সেতুটি এক হাজার ৪৭০ মিটার দীর্ঘ ও ১৯.৭৬ মিটার প্রশস্থতা নিয়ে ওই বছরের ২৪ জুলাই কাজ শুরু হয়। অর্থাৎ, প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র পাঁচ মাস আগে। বিদেশি অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৪১৩.২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, গত সাড়ে ৯ বছরে এ প্রকল্পের ব্যয় তিনবার সংশোধন করা হয়, সময়সীমা দুবার পিছিয়ে দেয়া হয় এবং ছয়বার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়। প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় এখন বেড়ে এক হাজার ৪৪৭.২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আনুমানিক মূল ব্যয়ের সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। দুই বছরের ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ সংশোধিত মেয়াদ এখন ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কার্যাদেশে সেতু নির্মাণে ৩৩ মাস সময় বেঁধে দেয়া হলেও দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে তার আগেই ২৪ অক্টোবর এটি যাতায়াতের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে। দুই বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড মানে হচ্ছে, প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার দুই বছরের মধ্যে যদি নির্মাণে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, ঠিকাদাররা নিজ খরচে সেটি ঠিক করবেন।

পায়রা সেতু চালু হলে দেশের সর্ব দক্ষিণের বিভিন্ন স্থানের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। যোগাযোগ, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। পায়রা সমুদ্রবন্দর হওয়ায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি আরো বেগবান হবে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। 

পায়রা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলে এ অঞ্চলের সাথে সারা দেশের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজতর হবে। ইতোমধ্যে চলমান মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন করে ইপিজেড করার কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে যা এক সময়ের অবহেলিত পটুয়াখালীকে সম্ভাবনার প্রবেশদ্বারে রূপান্তরিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।

লেখক : ব্যাংকার-কলামিস্ট