Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

জনমিতিক লভ্যাংশ, দক্ষ যুবসমাজ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

মো. আকতারুল ইসলাম

নভেম্বর ১২, ২০২১, ০৬:০৫ পিএম


জনমিতিক লভ্যাংশ, দক্ষ যুবসমাজ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

যুব শব্দটি দেখলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে লেখা কবি হেলাল হাফিজের কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এর সেই কালজয়ী পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। সেই সময়ের আন্দোলনের স্লোগানে এ পঙক্তি যুবদের অনুপ্রাণিত করেছে, সাহসী করে তুলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই যুবরাই ছিলেন অগ্রগামী। 

এই পঙক্তিটি আমাদের এখনও সাহস ও প্রেরণা জোগায় উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে, সোনার মানুষ চাই’। এই সোনার মানুষই হলো যুবসমাজ। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুব। এই বিশাল যুবসমাজের শক্তি, উদ্যম, সাহস আর কর্মস্পৃহা আমাদের দেশকে আরো উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।

বিশ্বের সকল দেশের সামনে আজ জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন। 

এসডিজির মূল থিম হচ্ছে- ষবধাব হড় ড়হব নবযরহফ. আর এসডিজির মূলকথা চারটি জাদুকরী শব্দ ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’। সমাজের কাউকে পিছিয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পূর্ণতা পাবে না। অন্যদিকে রূপকল্প-২০৪১ মানে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ। আর উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ মানে সেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য।

মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দরিদ্রতা শূন্যে নামিয়ে আনতে হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।

দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সুদূরপ্রসারী ভাবনা, পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও অগ্রাধিকার খাতভিত্তিক বিনিয়োগ আবশ্যক, যে বিনিয়োগে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী নিজেদের শ্রম ও মেধা দিয়ে অর্থনীতির চাকাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরো গতিশীল করতে পারে। আর এ জন্য আমাদের সামনে এক বিরাট সুযোগ হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে একটি দেশের জনসংখ্যার বয়স চিত্রের তারতম্য, যা জন্মহার ও মৃত্যুহার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে ঘটে থাকে। এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ১৫-৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা।

অর্থাৎ ১৪ বছরের নীচে ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে এমন মানুষের সংখ্যার পার্থক্য। অন্যভাবে বলা যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি কর্মক্ষম নন এমন মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হয়। জনমিতিক লভ্যাংশ থেকে চারটি সুবিধা পাওয়া যায়: শ্রমের জোগানের উন্নতি; সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি; মানবপুঁজি ও দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ। 

এ চারটি সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে যদি এ কর্মক্ষম যুবশক্তিকে কাজে লাগানো যায়। এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি দেশে সর্বোচ্চ ২০-৩০ বছর স্থায়ী হয়। অর্থাৎ, ২০৪০ সাল নাগাদ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগটি হ্রাস পেতে শুরু করবে।

বর্তমানে আমাদের দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২০৪০ সালের মধ্যে যদি এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যবহার করা না যায়, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড পার হয়ে গেলে জন্মহার ও মৃত্যুহার আরও কমে যাবে এবং বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা সংকুচিত হতে

থাকবে। বর্তমানে যারা যুব শুধু তারাই নয়, আজকে যারা শিশু বিশ বছর পরে তারা পূর্ণ কর্মক্ষম যুব আর তাদের নিয়েও সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মধ্যেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন নির্ভর করছে।

সঠিকভাবে ব্যবহারের মানে হলো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলে কাজে লাগানো। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা সংস্কার ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। একটি জাতি এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ একবারই পায়। যে কোনো দেশে এই সুযোগটি দুই বা তিন দশকব্যাপী বহাল থাকে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনমিতির বোনাস প্রাপ্তির স্বর্ণযুগ চলছে। সবাই মিলে এখনই এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।

দ্রুত পরিবর্তনশীল আগামী দিনের শ্রমবাজার হবে দক্ষতানির্ভর। এ লক্ষ্যে রফতানিমুখী শিল্পায়ন, কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নগরের বিস্তার, দক্ষ জ্বালানি ও অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ইত্যাদি কৌশলগত কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তাই সরকার ‘মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন এবং জনমিতিক লভ্যাংশ আহরণ’ শীর্ষক জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জাতির পিতার স্বপ্নে মোড়ানো সোনার বাংলা বিনির্মাণে সরকারের সব অর্গানগুলো নিরলস কাজ করছে। সরকার অসংখ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনের মহাসড়কে তুলে নিয়েছে। আর দু’তিন বছরের মধ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দৃশ্য উন্নত বিশ্বকে বিস্মিত করবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, বিদ্যৎ প্রকল্প ও শিল্পখাতসহ সবখাতে চলছে বিস্ময়কর উন্নয়ন। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে হবে কোটি মানুষের কর্মসংস্থান।

জনমিতির বোনাস এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে শিল্পকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থান এবং জনশক্তি রপ্তানি প্রভৃতি বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর গবাদিপশু, হাঁস মুরগি, মৎস্যচাষ ও কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ প্রশিক্ষণ, চিংড়ি  ও কাঁকড়া চাষ, ছাগল ও ভেড়া পালন এবং বিপণন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের জন্য দায়িত্বশীল মৎস্য আহরণ, মাশরুম ও মৌ চাষ, লাইভস্টক এসিসটেন্ট ও মোবাইল সার্ভিসিং এন্ড রিপেয়ারিং প্রশিক্ষণ কোর্স থেকে শুরু করে মডার্ণ অফিস ম্যানেজমেন্ট এন্ড কম্পিউটার এপ্লিকেশন, পোশাক তৈরি ও হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্স কোর্স, রেফ্রিজারেশন এন্ড এয়ারকন্ডিশনিং প্রশিক্ষণ, ইলেক্ট্রনিক্স প্রশিক্ষণ, ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড হাউস ওয়্যারিং প্রশিক্ষণ, ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস, টুরিস্ট গাইড এবং শতরঞ্জি প্রশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্স / আউট সোর্সিং প্রশিক্ষণ কোর্স দেশে চালু আছে। এ সমস্ত অসংখ্য ট্রেডে ৬৪টি জেলা কার্যালয়ে অনাবাসিক ও ৫৮টি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আবাসিকভাব ১-৬ মাস মেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং ১০টি মেট্রোপলিটন থানাসহ ৪৯৮টি উপজেলায় ৭-২১দিন মেয়াদি ৪২টি ট্রেডে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ সকল ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ যুবদের কর্মসংস্থান হয়েছে। বলা যায় যুবদের কর্মসংস্থানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশনসহ সরকারের আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মসংস্থান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা চুড়ান্ত পর্যায়ে।

তবে জনমিতিক লভ্যাংশ ভোগ ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রশিক্ষণের মান বাড়ানো সময়ের দাবি। এসডিজি এবং রূপকল্প ২০৪১ এর প্রবাহমান ধারা একই মোহনায় মিলিত হয়েছে। দু’টি লক্ষ্য পূরণেই প্রয়োজন সমাজের সকলকে একই তরীতে মোহনায় পৌঁছানো। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নত-সমৃদ্ধ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বো এটাই হোক সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। (পিআইডি ফিচার)