Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

জেন্ডার সহিংসতা ও সংবেদনশীলতা

মো. তানজিমুল ইসলাম

নভেম্বর ২৫, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


 জেন্ডার সহিংসতা ও সংবেদনশীলতা

অতি সাধারণ মানুষের কাছে ‘জেন্ডার’ মানে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ‘নির্যাতন’ টাইপের একটি বিষয়। আশির দশকে বিষয়টি প্রায় এমনই ছিলো কিন্তু কালক্রমে এ ধারণার অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও জনমনে ভ্রান্ত ধারণাটি যেন অস্থি-মজ্জার সাথে মিশে আছে। উন্নয়ন জগতে ‘জেন্ডার’ হলো নারী-পুরুষের সমতায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বা বিশেষ উদ্যোগ। 

জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের সমাজে নারী-পুরুষেরা যখন সমান তালে কাজ করছে, এবং সর্বোপরি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতার মাধ্যমে দায়িত্ব বন্টন করে নিচ্ছে, জেন্ডারের উদ্দেশ্যও ঠিক তক্ষুনি সফল হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে, পরিস্থিতির বিবেচনায় কৌশলগত কারণে ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নারীর প্রতি পুরুষের ; পক্ষান্তরে, পুরুষের প্রতি নারীর যে সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও কাজ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবার যে উদ্যোগ তা-ই মূলত: উন্নয়ন জগতে ‘জেন্ডার’ হিসেবে অভিহিত। 

বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করেছে; সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ পদক্ষেপের ফলে নারীরা আজ প্রায় সর্ব দিক থেকেই এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-অধিকার-মত প্রকাশের স্বাধীনতা-স্বনির্ভরতায় নারীরা দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখলেও আজো নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে হরহামেশায়। 

‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে’ বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পেইন, প্রতিবাদ, সমাবেশ, গোল টেবিল বৈঠক, মানববন্ধন কর্মসূচি, ইত্যাদি প্রচলিত। বছরের পরে বছর চলে যায়, সময়ের আপন নিয়মে কর্মসূচি পালিত হতে থাকে তবু একটি বিশেষ শক্তিধর গোষ্ঠী বহাল তবিয়তে তাঁদের পৌরুষ আচরন প্রতিষ্ঠা করতে থাকে অত্যাধুনিক কায়দায়। 

শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই নয় বরং সারাবিশ্বের মানুষের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে একটি নেতিবাচক বিশ্বাস: ‘নারীরা অবহেলিত-নির্যাতিত-বঞ্চিত’ ইত্যাদি! বাস্তবতা যাই হোক না কেন, শুধুমাত্র নারীদেরকে ‘মানুষ’ হিসেবে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন না করার কারণেই এই চিত্রটি স্থায়ীভাবে আটকে আছে। নারীর উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে এই জ্যামটি তাঁদের গতিশীলতাকেই কেবল ব্যহতই করছে না বরং পিছিয়ে দিচ্ছে একটি জাতিকে। 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাংলাদেশেও একজন মেয়েকে ‘নারী’ হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাঁর চলাফেরা, মতামত প্রকাশ এমনকি যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছার গাইডলাইন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নারী নির্যাতনের শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী জনবলের মধ্যে বিশেষ করে সেবক অথবা সেবিকাদের মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। 

এই নারীরাই আবার আজকের এই কোভিড-১৯ এর মহাসংকটেও নিজেকে নিয়োজিত করেই চলেছে। অথচ তাঁদের স্বীকৃতি মিলছে না, কিছুতেই না! নারীর উন্নয়নের কথা বলার পরেই জনৈক আলোচক যখন নিজের স্ত্রীর প্রতি শারীরিক তথা পারিবারিক সহিংসতার অনুঘটক হন তখন বিষয়টি বড্ড সাংঘর্ষিকই বটে!  

বিভিন্ন পত্রিকার তথ্যমতে, জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতার মধ্যেও সারদেশে প্রায় ৫০০ টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেছে আট শতাধিক। 

এছাড়া, অপ্রকাশিত ঘটনার সংখ্যাটি কেবল অনুমান করে নিলেই বোঝা যায়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো অধিকাংশ ধর্ষন তথা অন্যান্য নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলি ঘটছে প্রায় নিকট আত্নীয় পরিজন দ্বারাই। অর্থাৎ নারীরা কোথাও তেমন একটা নিরাপদ নয় বললেই চলে। কঠোর এই পুরুষতান্ত্রিকতার কু-প্রভাবে আর ধর্মীয় অনুশাসনের জাঁতাকলে নারীকে পিষ্ট করা হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তে! 

অথচ, প্রতিটি ধর্মেই নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার আহ্বান করা হয়েছে সু-স্পষ্টভাবে।  বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর এই ১৬ দিনব্যাপী এক বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। 

এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘যতদিন নারীরা নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না, যতদিন নারীদের নিরাপত্তা ও সহিংসতা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হবে, ততদিন বিশ্ব নারীদের সমানাধিকারের ব্যাপারে অহঙ্কার করতে পারবে না। বিশ্বের সব দেশের নারী, যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন বা বেঁচে ফিরে এসেছেন তাদের জন্য অথবা তাঁদের হয়ে কথা বলার জন্য জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল শ্রেনী-পেশার জনগণকে আহ্বান করা হয়েছে ! 

নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলা কোন সহজ কাজ নয়! যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাই সর্বাগ্রে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারে, বিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে, শহরে, বন্দরে, যানবাহনে, এমনকি বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরী। 

নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর একজন নারীর প্রয়োজনীয় আইনি ও চিকিৎসা সহায়তার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষের যে ন্যায্য অধিকার ও গুরুত্ব রয়েছে; উভয়ে মিলে যে অভিন্ন সত্ত্বা, এই মানবিকতাবোধ সমাজ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে নারীর প্রতি বৈষম্য চলতেই থাকবে। 

আর এই কাজগুলো শুরু করতে হবে একদম গোড়া থেকে, পরিবার থেকে। তাই আসুন সবাই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ করি নারী নির্যাতন। উপরোক্ত করনীয়সমূহ নিতান্তই মানবজাতির! নারীজাতিকে ‘মানুষ’ হিসেবে যোগ্য সম্মান প্রদান করবার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদের সকলের, বিশেষ করে পুরুষ জাতির।

জেন্ডার সহিংসতা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে; জনমনে সচেতনতাও বেড়েছে তথাপি ইদানিংকালে একটি বিষয়ে নতুন করে চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে, তা হলো নারী ও শিশু ধর্ষন ! নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে অকপটে তাদের ধর্ষিত হবার গল্প শোনালেও বেশির ভাগ মানুষই তা আমলে নিতে চান না। 

বিভিন্ন আলোচনায় ফিসফিসিয়ে বা কুর্নিশ করে অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘সময় এসেছে ধর্ষন বিরোধী আলোচনার’ বিষয়টি আলোকপাত করবার ! কোর্টে নারী নির্যাতনমূলক মামলার অধিকাংশই যখন মিথ্যা, বানোয়াট আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত হিসেবে ধামাচাপা দেয়া হয় তখন বিষয়টি নতুনভাবে ভাবিয়ে তোলে ! 

এক্ষেত্রে নারীরা বড্ড অসহায় আর লজ্জার চাদর গায়ে জড়িয়ে দিনানিপাত করে। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হলেও বলার পরিবেশ নেই। নারীরা কিল খেয়ে কিল হজম করে চুপচাপ থাকে, এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে! অমানবিক নির্যাতনের শিকার যেদিন একসাথে প্রতিবাদ করবে সেদিন হয়তো লজ্জায় কুটি কুটি হাসবে নতজানু পুরুষ সমাজ । 

সঙ্গত কারণেই লোকলজ্জার ভয়ে ‘নারী জাতি’ আজ বড্ড একা যা তিনি কোন নিকট বন্ধুকেও জানাতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেননা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদের বিভিন্ন ঐক্যজোট রয়েছে, টক শো’তে আলোচনার ঝড় উঠে, অথচ ঠিক সেই মুহুর্তেই নির্যাতিত নারীরা লুকিয়ে-লুকিয়ে, ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে আড়ালে আবডালে! 

এহেন অনিয়ম-অন্যায়-অনাচার-বৈষম্য দূরীকরণে সকলের ঐক্যমত সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করছি, ‘আসুন, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে জেন্ডার সহিংসতা নির্মূল করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকে জেন্ডার সংবেদনশীল হই।             

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, এডভোকেসি এন্ড সোশ্যাল একাউন্টিবিলিটি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।