Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

জ্ঞানের দেবী সরস্বতী

জানুয়ারি ২৫, ২০১৫, ০১:৪৫ পিএম


জ্ঞানের দেবী সরস্বতী

 

সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার সূর্যাগ্নিরূপে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-এর শক্তি জ্যোতিরূপা সরস্বতী। সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। ভূলোক, অন্তরীক্ষলোক ও স্বর্গলোক নিয়েই জগৎ। এ জগৎ জ্যোতিরূপা সরস্বতীর জ্যোতিতে ভাস্বর। এর অমিয় জ্যোতিধারা সর্বব্যাপী। এর চিরভাস্বর আলোকে সাধকের অজ্ঞান দূরীভূত হয় এবং অন্তর পূর্ণ হয় জ্যোতিতে। এই জ্যোতিই সরস্বতী। সরস+বতু+ঈপ্‌ প্রত্যয় যোগে ‘সরস্বতী’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। সরস্‌ অর্থে জ্যোতিঃ। জ্যোতির্ময়ী বলে তিনি সর্বশুক্লা।

বেদে সরস্বতী ‘দেবীতমে’ ‘অম্বিতমে’ ও ‘নদীতমে’ নামে আখ্যায়িকা। এভাবে সরস্বতী মহিমাও ত্রিবিধ-দেবী, মাতা ও নদীরূপা। পরম জ্যোতিস্বরূপিণী বলে তিনি দেবীতমা। পরম জ্ঞান দান করে অবোধ ও অজ্ঞান সন্তানকে পালন করে; অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন, এবং মায়ের মত মূক কণ্ঠে ফুটিয়ে তোলেন ভাষা’ তাইতো তিনি অম্বিতমা; সন্তান বাৎসল্যে বিগলিতা-তাই তিনি দ্রবময়ী’ ইনিই নদীতমা। ত্রিলোক বিচরণশীলা জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী জলময়ী মর্ত্য সরস্বতীতে অবতীর্ণা হলেন। নদীর কলকল ধ্বনি নাদময়ী হয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞান ও বাক্যের উৎপাদনকারিণী। নদীতটে বসবাসকারী ঋষিদের তিনি হলেন বাগ্‌ দেবী বা বিদ্যাদেবী।

প্রকাশময়ী জ্যোতিরূপিণী সরস্বতী আমাদের জ্ঞানদায়িনী মা। আবার নদীরূপা সরস্বতী ধরাধামে অবতীর্ণা হওয়ায় ধরণী হয়েছে শস্যশ্যামলা, তাই তিনি অন্নদাত্রী মা। দেবী সরস্বতী ও নদী সরস্বতী উভয়ই আমাদের মা। আবার সরস্বতী অন্য অর্থে ‘পাবকা’-শোধয়িত্রী। ইনি সকল পাপনাশ করে হৃদয়কে জ্ঞানালোকে শুদ্ধ ও পবিত্র করেন। সরস্বতীর স্তুতিতে দেখা যায় ইনি ‘ধিয়াবসু’। ধিয়া-কর্মদ্বারা, বসু-ধন। অর্থাৎ কাম্যকর্মে ধন, ঐশ্বর্য ইত্যাদি মুখ্য। সরস্বতী স্তবে আমরা দেবীকে অনেক ব্যাপক অর্থে দেখতে পাই। এক কথায় তিনি সকল ঐশ্বর্যের সিদ্ধিদাত্রী। বাহ্যত এ দেবী সর্বশুক্লা, পুস্তক ও বীণাপাণি, হংসরূঢ়া, শ্বেতবসনা ইত্যাদি। নিগূঢ় অর্থে এ দেবী সর্ব ঐশ্বর্যদায়িনী, জ্ঞানময়ী, সর্বব্যাপিনী, পরমাত্মরূপিণী। এই দেবীর বিভিন্ন স্তব, স্তুতির মধ্যে নিহিত এক পারমার্থিক জ্ঞানের আভাস। এজন্য বাগ্‌ দেবীর অর্চনায় ব্যাপকতা ও মাধুর্য।

সরস্বতী মূর্তি-কল্পনায় নানারকম বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কখনও লক্ষ্মীরূপ প্রাধান্য লাভ করেছে। কখনও বা সরস্বতী নিজস্ব রূপাধারে লক্ষ্মীর রূপকে প্রভাবিত করেছে। মোটামুটি উভয় মূর্তির কল্পনাতে একটা সাদৃশ্য আছে। বীণা পুস্তকধারিণী লক্ষ্মীমূর্তি দেখা যায়। কালের ব্যবধানে সরস্বতী অগ্রজা। কাজেই সরস্বতীর প্রভাব লক্ষ্মী প্রতিমার উপর পড়তে পারে। এটা হয়তো স্বাভাবিক। সে যাহোক আমরা খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মূর্তি কল্পনার একটি ভাবময় রূপ দেখতে পাচ্ছি। সরস্বতীর ধ্যান-মন্ত্রে এটি ফুটে উঠেছে:

ওঁ তরুণ-শকলমিন্দো-র্বিভ্রতী শুভ্রাকান্তিঃ।

কুচভর-নমিতাঙ্গী সন্নিসণ্না সিতাজে।।

নিজকরকমলো-দ্যল্লেখনী-পুস্তকশ্রী।

সকল বিভবসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগ্‌দেবতা নমঃ।।

অর্থাৎ, যার ললাটে বিরাজিত তরুণ শশিকলা, যিনি শুভ্রবর্ণা, কুচভারাবনতা, শ্বেতপদ্মে-আসীনা, যার এক হস্তে উদ্যত লেখনী ও অপর হস্তে পুস্তক শোভা পায়, সেই বাগ্‌ দেবী সকল বিভব সিদ্ধির নিমিত্ত আমাদের রক্ষা করুন।

বহির্বিশ্বে সরস্বতীর মত নামান্তরে বিভিন্ন দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। কয়েকটি নাম প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য। যবদ্বীপে পদ্মসীনা বীণাবাদানী সরস্বতী, তিব্বতে ব্রহ্মবাদিনী বীণাপাণি সরস্বতী, জাপানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা বীণাপাণি সরস্বতীর পরিচয় পাওয়া যায়। চীনদেশের এক শস্য দেবী কুয়ান যিন্‌ নামে আরাধিতা। ইনি শস্যের দেবী এবং মানবকূল রক্ষাকারিণী। সরস্বতীর ন্যায় ইনি পূজিতা। মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইসতার’ নামে মাতৃকা দেবী পূজিতা। ইনি ব্যবিলনীয়, এসিরীয় ও ক্যানানীয়দের কাছে প্রেম, উর্বরতা ও যুদ্ধের দেবী হিসেবে গণ্যা। এ দেবী সিংহবাহনা। সরস্বতীসদৃশ্য এক গ্রীক দেবী ‘এথেনী’ নামে পূজিতা। এথেনী-এথেন্স নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ইনি ন্যায় বিচারের প্রতীক। ইনি আলোকময়ী, চারু ও কারু শিল্পের দেবী।তবে এ দেবীর সরস্বতী-চরিত্রগত সাদৃশ্য নেই। রোমের দেবী মিনার্ভার সঙ্গে সরস্বতী দেবীর একটু সাদৃশ্য আছে। ইনি বিদ্যা ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এ ধরনের আরও আরাধিতা দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আমাদের দেবী সরস্বতীর গুণ ও রূপবর্ণনায় সাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক ভাবের বিকাশ অতি সমৃদ্ধ। কবি ভারত চন্দ্রের ভাষায় বন্দিতা দেবী সরস্বতী:

শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস

শ্বেতবীণা শ্বেতহাঁস

শ্বেত সরসিজ-নিবাসিনী।

বেদবিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র

বেণু বীণা আদি যন্ত্র

নৃত্যগীত বাদ্যের ঈশ্বরী।।

এই পুণ্য দিনে দেবী সরস্বতী চরণে প্রদান করি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রণতি।

এই মন্ত্রে-

ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

বেদবেদান্ত বেদাঙ্গ বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ ।।

-অর্থাৎ দেবী ভদ্রকালী সরস্বতীকে নিত্য পুনঃ পুনঃ প্রণাম এবং বেদ বেদান্ত ও বিদ্যাস্থানসমূহে প্রণাম করি।