Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

নন্দিত ইমাম হুসাইন, নিন্দিত ইয়াযীদ

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

আগস্ট ১৯, ২০২১, ০৯:০৫ এএম


নন্দিত ইমাম হুসাইন, নিন্দিত ইয়াযীদ

"কাতলে হুসাইন আসল মে মারগে ইয়াযীদ হ্যায়, ইসলাম যিন্দাহ হোতা হায় হার কারবালা কে বা'দ।" অর্থাৎ, ইমাম হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইয়াযীদেরই মৃত্যু ঘটেছে; ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়। 

মুখে মুখে সমাদৃত এ সত্য উক্তি কারবালার দর্শনকে শানিত করে। মহাকবি আল্লামা ইকবালের এ পংক্তিটি কারবালায় বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিকে এড্রেস করে। পরিস্কার জানিয়ে দেয় ইমাম হুসাইনই (রা.) বিজয়ী। 

বিজয়ী হুসাইনের অগ্রজ ইমাম হাসান (রা.)। বিজয় হুসাইনের গর্বিত পিতা বেলায়তের সূর্য মাওলা আলী (রা.)'র। সফলতার সৃষ্টি হুসাইনের রত্নাগর্ভা জননী খাতুনে জান্নাত মা-ফাতেমা (রা.)'র জন্য। বিজয় হুসাইনের নানিজান আল্লাহর সালাম পাওয়া সৌভাগ্যবতী খাদিজাতুল কুবরা (রা.)'র। বিজয় ধ্বনি হুসাইনের নানাজান ইমামুল আম্বিয়া নূর নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.)'র দান। বিজয় হুসাইন খান্দানের। বিজয় শুধু ৬১ হিজরী সনে নয়। এ বিজয়ের সূচনা নীলগগন সৃষ্টির আগে। 

মালিকে হাক্বীকি মহান আল্লাহ জীব সৃষ্টির বহুকাল আগে সযত্নে নূরে মুহাম্মদি (দ.)-কে সৃষ্টি করে বিজয়ের বার্তা দিয়েছেন; অসত্য যত প্রখর হবে সত্যের সূর্যোদয় তত করিব হবে। এ বিজনে মোস্তাফা (দ.)'র শুভাগমনে মুমিন আত্মা গেয়ে উঠে 'মোস্তফা জানে রহমাত পে লাখো সালাম'। 

ত্রিভুবন বিজয়ী প্রিয় মুহাম্মদ (দ.)'র শাহজাদার নাম ইমাম হুসাইন। বিজয়ী নানার জয়ী দৌহিত্র ইমাম হুসাইন। 'হুসাইন' নিছক কোন নাম নয়; বরং নাম 'হুসাইন' রহমতের মালিকের দেওয়া জান্নাতি সুঘ্রাণ। হুসাইন সাধারণ কোন আরোহী নন; বরং হাবিবুল্লাহ (দ.)'র নূরানী কাঁধে আরোহীর নাম। 

মোস্তফা (দ.)'র নূরানী ঠোঁটের চিহ্ন অঙ্কিত শরীরের নাম ইমামে আলী মকাম। হুসাইন স্রেফ একটি ব্যক্তি নন; বরং হুসাইন একটি পৃথিবী। যে পৃথিবীতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যে পৃথিবীতে আছে শান্তি আর মুক্তি। যে পৃথিবী প্রভুভক্তির ইমারতে গড়া। ইমাম হুসাইন একটি বিপ্লব, নবজাগরণ ও সফল আন্দোলনের নাম। যে আন্দোলন একষট্টি হিজরির ১০ই মুহররম কারবালার প্রান্তর থেকে চূড়ান্তভাবে শুরু হয়ে চলমান আছে আজ অবধি। চলবে কিয়ামততক। 

দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মাদক, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইমাম হুসাইন নিঃসন্দেহে তেজোদ্দীপ্ত প্রেরণা। অভিশপ্ত ইয়াযীদের হাতে বায়াতের (আনুগত্য) অফার অগ্রাহ্য করে তার দুঃশাসন, স্বৈরাচারনীতি, অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড, ব্যভিচার, ঘৃণিত পদক্ষেপ ও গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম ইমাম হুসাইন। ইমাম হুসাইন একটি সাহসিকতার নাম। যে সাহসের কাছে ২২ হাজার সশস্ত্র জাহান্নামি ইয়াযীদী সৈন্য ভয়ে তরতর। ইমামে হুসাইন ধৈর্যের ইস্পাত-দৃঢ় সুউচ্চ মিনারের নাম। ইমাম হুসাইন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান পাঠ ধৈর্যের অনুশীলন। 

মহান আল্লাহর ঘোষণা- ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানুছতা'ঈনূ বিসসাবরি ওয়াসসালা-তি; ইন্নাল্লা-হা মা'আসসাবিরীন। ধৈর্যই ইমাম হুসাইনের প্রধান ভূষণ। সে ধৈর্যের পাহাড়ের সামনে খোদার দ্বীন বাঁচাতে নিজের শক্তি আব্বাস আলমদারের দুই হাত কর্তিত নিথর দেহ; নিজের বুকের ধন আলী আকবরের রক্তাক্ত নিশ্চুপ শরীর; আদরের ভাই, স্নেহের ভাতিজা ও ভাগিনাদের রক্ত স্নাত নিস্তব্ধ জিসিম; নবীবাগের নিষ্পাপ গোলাপ ছয়মাসের শিশু আলী আজগরের বিষাক্ত তীর বিদ্ধ নিষ্প্রাণ নূরানী শরীর; কন্যা সৈয়দা সকিনার তৃষ্ণার্ত শুকনো মুখ; স্ত্রী শাহরবানুর সন্তান হারানো বোবাকান্না; বোন জয়নাবের শোকাভিভূত চেহেরা; হুসাইন শিবিরে স্বজনহারানো গগনবিদারী আর্তনাদ ইমাম হুসাইনের সবরের পর্দায় একটুও আঘাত হানতে পারেনি। 

তৃষ্ণার্ত প্রাণে একটাই ভরসা নানাজান রহমাতুল্লিল আলামীন অমিয়সুধা হাউজে কাউসার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন! একে একে ৭১টি তাজাপ্রাণের নিরুত্তাপ দেহ ইমামের কাঁদে উঠেছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ করুন দৃশ্য অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান ইমামে হুসাইন একটুও সাহস হারাননি। রক্ত স্নাত ফোরাততীর সেদিন হু হু করে কেঁদেছিল নবী বংশের পবিত্র রক্ত বুকে মেখে। 

আকাশ বাতাস বৃক্ষলতা হুসাইন শোকে মাতম করেছিল সেদিন। আসমান ও জমিনবাসী কিয়ামত সন্নিকটে ভেবে ভীতসন্ত্রস্ত। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য নাড়া দিয়েছে ইতিহাসবিদ গিবনের জ্ঞানে। তাই তিনি বলেছে, In a distant age and climate the tragic scene of the death of Husayn will awaken the sympathy of the coldest reader.অর্থাৎ "সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে, সমবেদনার সঞ্চার করবে।"

ইমাম হুসাইন আপোষহীন এক বীরের নাম। জান যাবে যাক, ইসলাম বেঁচে থাক। এ শ্লোগানটিই ইমামের শির উন্নত রেখেছেন। জান বাঁচার অবলম্বন অক্সিজেন হলেও দ্বীন বাঁচার অবধারিত অবলম্বন হলো রক্ত। মুমূর্ষু দ্বীন ইসলাম হুসাইনের পবিত্র রক্তে ফের জান ফিরে পান। ইমাম হুসাইন একটি প্রেরণার নাম। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও শান্তির বার্তা দিতে শেখায়। ইতিহাসবিদ ইবনে জারির তাবারির মতে, রক্তপাত বন্ধের দৃঢ়হৃদয়ে ইমাম হুসাইন ইয়াযীদ বাহিনীকে অসাধারণ তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। 

ইমামকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক কিংবা পাশ্ববর্তী যেকোনো সীমান্তে যেতে দেয়া হোক অথবা ইয়াযীদের সাথে আলোচনার জন্য তাকে দামেস্কে পাঠানো হোক। তার সাথে তিনি (ইমাম) বোঝাপড়া করে নেবেন। এতে সারা মিল্লাতের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে নির্লজ্জ আদেশ দেয়। সত্যের জিবন্ত উদাহরণ ইমাম হুসাইন ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। 

এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম মুর বলেন, Well had it been for the Umayyad house, if the prayer had been agreed to. অর্থাৎ "ইমাম হুসাইনের সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত।"

সেদিন ইমাম হুসাইন অন্যায়ের  কাছে মাথানত না করে সত্যান্বেষণীদের অন্তরে চিরজীবী হয়ে গেছেন। আপাতত দৃষ্টিতে একষট্টি হিজরির শাহাদাতে কারবালায় কেউ কেউ ইয়াযীদের বিজয় দেখলেও বোদ্ধামহল ঘুনাক্ষরে হুসাইনের পরাজয় দেখছেন না। 

বরং সেদিন চুড়ান্ত বিজয়ের রাজমুকুট ইমাম হুসাইনের রক্তাক্ত নূরানী শিরেই দিচ্ছেন তাঁরা। ঐতিহাসিকদের মতে কারবালার ট্রাজেডিতে সাময়িক জয়লাভ ইয়াযীদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল মূলত পরাজয়ের নামান্তর। কারবালার প্রান্তে নবী পরিবারের মর্মান্তিক, গগনস্পর্শী শাহাদাতের দৃশ্য সারা দুনিয়ার বিবেচক মানুষের কাছে ইয়াযীদকে বানিয়েছে খলনায়ক। তার উপর মানুষ এমনভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে যে, প্রায় চৌদ্দশ বছরেও কোনো মা তার ছেলের নাম ইয়াযীদ রাখেননি। আর অন্যদিকে অন্তঃসত্ত্বা মার ব্যকুলহৃদয়ের প্রত্যাশা ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তান দুনিয়ায় এলেই নাম দিব ‘হুসাইনথ। 

আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড থিউরিতে পরে কত শতবর্ষী মানুষ মরার আগেই মরে যায়। কিন্তু নবী বাগের গুলিস্তাঁ নওজোয়ান আলী আকবর আর দুধের শিশু আলী আজগর কোটি প্রাণে আজও চিরসজীব। মুসলিম প্রাণের রাজপ্রাসাদে ইমাম হুসাইনেরই বসবাস। পক্ষান্তরে ক্ষমতা দখলের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ইয়াযীদের ভাগ্যে করুন পরিনতি নেমে আসে। 

মাত্র অর্ধশত বছরের মধ্যেই নবী পরিবারকে কষ্ট দিয়ে উল্লাস করা নরপিশাচদের মর্মান্তিক মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছিল সৃষ্টিকুল। সীমালঙ্ঘনকারী ইয়াযীদের কবরও অযত্নে পড়ে আছে সিরিয়ায়। আজ যেকোনো জাতি-গোষ্ঠীর কাছে ইয়াযীদ অশুভশক্তির প্রতিশব্দ।

ঈমান-ইসলামের সেতুবন্ধন ইমাম হুসাইন। দ্বীনের বাস্তব নির্যাস ইমাম হুসাইন। সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীব নেওয়াজ কতইনা উত্তম বলেছেন, "শাহ আস্ত হুসাইন, বাদশাহ আস্ত হুসাইন। দ্বীন আস্ত হুসাইন, দ্বীন পানাহ আস্ত হুসাইন। সারদ্বাদ নাদ্বাদ, দাস্ত দ্বারে দাস্ত ইয়াজিদ। হাক্বকা কে বিনা লা-ইলাহা আস্ত হুসাইন।" পৃথিবীর যে প্রান্তে অন্যায়ের অন্ধকার নেমে আসবে, সে প্রান্তে হুসাইনী সূর্যোদয় অন্ধকার বিনাশীবে। 

জুলুমের দাবানল যতই ভয়াবহ হোক, হুসাইনী বারিধারার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করবেই। পৃথিবীর দেশে দেশে সত্যের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য শক্তির অন্তরালে এক একজন ইমাম হুসাইন বাস করে বলে, আজ পর্যন্ত সব যৌক্তিক আন্দোলন সফল হয়েছে। আদর্শের প্রতীক হুসাইন। দুনিয়াবাসীর স্থির বিশ্বাস ন্যায় ও ত্যাগের সুউচ্চ মিনার নন্দিত ইমাম হুসাইন। আর শয়তানের আপডেট ভার্সন হলো নিন্দিত ইয়াযীদ। 

আমারসংবাদ/এআই