Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

নিজ ভূমে পরবাসী সুবলা!

বালিয়াকান্দি প্রতিনিধি (রাজবাড়ী)

জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০২:৪৫ পিএম


নিজ ভূমে পরবাসী সুবলা!

বৃদ্ধা সুবলা রানী বিশ্বাস। বয়স ৮৫ পার হয়েছে। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর পূর্বে। স্বামীর ভিটায় জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস। জীবিকা চলে ভিক্ষা করে। সুবলার অভিযোগ, জমি জায়গা থাকতেও নিকটতম আত্মীয়রা গায়ের জোরে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। এমনকি ভিটায় থাকা মূল্যবান গাছও তিনি বিক্রি করতে পারছেন না। এ যেন নিজ ভূমে পরবাসী! এখন নিজের চিকিৎসা ব্যয় যোগানোর জন্য বাড়ীর গাছ বিক্রিতে প্রশাসনের সহযোগিতা চান।

সুবলা রাণী বিশ্বাস বহরপুর ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের মৃত প্রভাষ বিশ্বাসের স্ত্রী। একটি মেয়ে ভারতে স্বামীর সাথে রয়েছেন। জামাই মেয়ে এখানে থাকার জন্য বাড়ীতে আসলেও তাদেরকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ সুবলা রাণীর। তবে অভিযুক্তদের দাবী, তাদের বিরুদ্ধে সুবলা মিথ্যাচার করছেন। সুবলার অভিযোগ সঠিক নয়। তারা তাকে সহযোগিতাই করতে চান।

কয়েকদিন আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুবলার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় বর্তমানে তিনি পদমদী গ্রামের নিমাই চন্দ্র মোদকের স্ত্রীর আশ্রয়ে তার বাড়ীতেই আছেন। 

বালিয়াকান্দি থেকে রাজবাড়ী যেতে মূল সড়কে তেতুলিয়া বাজারের পূর্ব দিকে মাদ্রাসার পিছনের রাস্তা ধরে কিছুদুর এগোলেই সুবলার বসত ভিটা। ভিটায় জরাজীর্ণ একটি দুই চালা টিনের ছোট্ট ঘর। চাটাইয়ের বেড়া বাঁশের। খোলা বারান্দা মশারী দিয়ে ঘেরা। বুধবার সকালে গিয়ে তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

সুবলার বসতভিটার সামনেই একটি গোয়াল ঘর, সেখানে একজন পুরুষ ও নারী কাজ করছিলেন। তাদের কাছে সুবলা রানীর বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, কয়েকদিন আগে সুবলা বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত হয়। এরপর একজন তাকে নিয়ে গেছেন। বর্তমানে সেখানেই আছে। খিটমিটে স্বভাবের লোক সুবলা।তারা সুবলার ভিক্ষা করা বাদ দিয়ে তাদের সাথে থাকতে বললে সুবলা সেটি শোনেন না। বরং সুবলা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। 

সুবলার জমি জায়গা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, কিছু জমি জায়গা ছিলো, সেগুলো তার স্বামী বিক্রি করেছিলেন। তেতুলিয়া বল ফিল্ডের পাশেও জমি ছিলো। বর্তমানে ভিটায় পাঁচ শতাংশ জমি আছে। মাঠে কিভাবে কি আছে জানেন না তারা। ভিটায় থাকা গাছ সম্পর্কে তারা জানান, এগুলোও তো ইচ্ছে করলে উনি বিক্রি করে চলতে পারেন কিন্তু বিক্রি করেন না। এইতো কয়েকদিন আগে ঘরে যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় তখন তারাই তাকে উদ্ধার করেন। কথা শেষে তার নাম জানতে চাইলে তিনি সত্যরঞ্জন বিশ্বাস বলে পরিচয় দেন। সত্যরঞ্জন বিশ্বাস সম্পর্কে সুবলার ভাতিজা।

পদমদী নিমাই মোদকের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, সুবলা বারান্দায় বসে আছেন। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। সেখানে তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভিটা-বাড়ী থাকতেও আমি অন্যের বাড়ীতে আশ্রয়ে আছি। আমার বিদ্যুৎস্পৃষ্টের কথা শুনেই নিমাইয়ের স্ত্রী মানবিক কারণে আমাকে বাড়ী থেকে তার বাড়ীতে এনে রেখেছেন। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আমার ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। নিমাই বাবু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো, ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। নিমাই তো আর আমার আপনজন না, ওরা আমার জন্য অনেক করেছে।’

সুবলা রানী বলেন, ‘আমি আর কয়দিন বা বাঁচবো। আমি মরে গেলে সব তো সত্যরঞ্জনরাই পাবে। অথচ আমার দুঃসময়ে আমার ভিটার গাছটিও বিক্রি করতে পারি না। এমনকি একটা ডাল কাটতে গেলেও ওরা বাধা দেয়। আমাকে মারধরের হুমকি দেয়। আমার মেয়ে-জামাই আসছিলো, ওরা তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারী সুবিধা বলতে বিধবাভাতা পাই। আমি এখন মৃতপ্রায় অথচ ওদের কেউ আমার কোন খোঁজ নিলো না। আমি শেষ সময়ে চিকিৎসা ব্যয় যোগাতে অন্তত বাড়ীর কয়েকটি গাছ বিক্রি করতে চাই।’ এসময় সুবলা প্রশাসনের মানবিক সহযোগিতা কামনা করেন। 

[media type="image" fid="107899" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

তেতুলিয়া বাজারের পাশেই বাড়ী মুহা: শাহজাহান সিদ্দিকীর। তিনি বর্তমানে উপজেলা এনজিও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। তেতুলিয়া বাজারে তার একটি হোমিও চিকিৎসালয় রয়েছে। প্রায়ই তার কাছে ওষুধের জন্য আসে সুবলা রানী। সুবলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুবলা দোকানে ওষুধের জন্য আসলে দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেন, কান্নাকাটি করেন। তার জমি জায়গা রয়েছে সেটিও বলেন। সেই জমিগুলো নিকটতম পরিজনরা জোর করে ভোগদখল করছে। এমনকি বাড়ীর গাছ বিক্রিতেও নাকি বাধা দেয়, সেটিও বলে কান্নাকাটি করেন। সুবলার বিধবা ভাতার কার্ড রয়েছে। সেটা তো খুব অল্প। এখন সুবলার চিকিৎসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তিনি উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মানবিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

নিমাই চন্দ্র মোদক বলেন, সুবলা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ১৫-১৭ দিন পূর্বে সুবলা ঘরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। সে বর্তমানে তার বাড়ীতেই আছে। সাধ্যমত তার স্ত্রী তাকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তার স্ত্রীও অসুস্থ। চিকিৎসক সুবলার ডান হাত অপারেশনের কথা বলেছেন। সুবলা প্রায়ই বলে তার জমি-জায়গা আছে। এমনকি ভিটায় মূল্যবান কয়েকটি গাছও রয়েছে। সেগুলো নাকি তার নিকটতম লোকজন দখল করছে।

সুবলার ভাতিজা সত্যরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘তার অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। আমরা সাধ্যমত তার সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু সে আমাদের কথা শোনেন না। তার গাছ সে কাটলে আমরা বাধা দিবো কেন। প্রয়োজনমত তার সম্পদ সে ব্যবহার করবে সেটাই স্বাভাবিক।’ 

বহরপুর ইউনিয়নের ৪নং ইউপি সদস্য নাদের আহম্মেদ বলেন, তার বাড়ী সুবলা রানীর বাড়ীর পাশেই। সুবলা একরোখা ধরনের। সে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। করোনাকালে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এই বৃদ্ধ বয়সে সে তো তার ভাতিজাদের সাথেই থাকতে পারে। সে সেটি করেন না। তার ভাতিজাদের বিরুদ্ধে তার যে অভিযোগ সেটির সবগুলো সত্য নয়। 

বহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল করিম বলেন, তিনি সুবলাকে চেনেন। তার নিকট আসলে তাকে কখনো খালি হাতে ফেরত দেননি। সব সময় সহযোগিতা করেন। সে কোন ধরনের সুুবিধা পায়না এটা আসলে ঠিক নয়। তিনি সুবলার সার্বিক খোঁজ খবর নিয়ে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করবেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, ‘আমি আপনার মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হলাম। সুবলা রানীর সার্বিক সহযোগিতা করবে প্রশাসন।’
 
আমারসংবাদ/এমএ