Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সুন্দরী মডেলের ভয়ঙ্কর রূপ, অপহরণ করলেন বান্ধবীর হবু স্বামীকে

যশোর প্রতিনিধি

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১, ০৬:২০ এএম


সুন্দরী মডেলের ভয়ঙ্কর রূপ, অপহরণ করলেন বান্ধবীর হবু স্বামীকে

যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়ায় অ্যাডভোকেটকে অপহরণের পর নির্যাতন ও ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় জড়িত আরও দুইজন পলাতক রয়েছেন।

চাঞ্চল্যকর ওই অপহরণ ঘটনা ও পরবর্তীতে পুলিশি অভিযানের বিষয়ে বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে যশোরের পিবিআই যশোর জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন জানান, আটককৃতরা উচ্চাভিলাষী, নেশাগ্রস্ত ও ভয়ংকর অপরাধী। এর আগেও কয়েকটি জঘন্য কাজ তারা করেছে। কাঙ্খিত টাকা না পাওয়া ও অপহরণ নির্যাতন ঘটনা পুলিশ জেনে যাওয়ায় অ্যাডভোকেট মিলনকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি খুলনা থেকে অপহরণ হওয়া সাতক্ষীরার তালা উপজেলার অ্যাডভোকেট আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনকে (৩৩) ৯ ফেব্রুয়ারি যশোরের অভয়নগর নওয়াপাড়ার একতারপুরের রাবেয়া খাতুনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আহত অবস্থায়। ওই বাড়ি থেকেই আটক করা হয় খুলনার দিঘলিয়া ফরমায়েসখানা দেয়াপাড়ার জমির সরদারের ছেলে আব্দুস সালাম (২৪), আলাউদ্দিন শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার (১৮) ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সুলতানপুর বড় বাজার এলাকার মৃত আজমল হকের মেয়ে সুরাইয়া ওরফে নীল (২০)।

এছাড়া এ ঘটনায় আটক সুরাইয়া ওরফে নীলের স্বামী হাবিব মিলন ওরফে রাজ জড়িত বলে তথ্য মেলে।

অ্যাডভোকেট মিলনকে ২ দিন পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি তার পরিবারের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে, এমন একটি জিডির সূত্র ধরে তদন্তে নামে পিবিআই যশোর। খুলনা দিঘলিয়া সাতক্ষীরা যশোর নওয়াপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় দুদিন ধরে অভিযান পরিচালনা করে আটক ও উদ্ধারের এই সফলতা দেখায় পিবিআই।

পিবিআই জানিয়েছে, সুুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফার সঙ্গে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানাধীন প্রতাবনগর গ্রামের এসএম হারুনর রশিদের মেয়ে রাবেয়া সুলতানা রিতুর (২২) পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়।

অপরদিকে নীলের স্বামী রাজ আগে একটি কোম্পানিতে চাকরি করেছে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেয়ার পরপরই প্রতারক হয়ে ওঠে। মানুষকে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে মোটরসাইকেল বা টাকা কোনোটাই দিতো না। আর নীল একসময় ঢাকাতে থাকতো, ভিডিও মডেলিংয়ের সাথে যুক্ত ছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সুরাইয়া নীল ও রাজ অনলাইনে ‘মধুর মধু’- নামে পেইজ খুলে ফেন্সিডিল, ইয়াবা বিক্রি করতো। ওই সময় খুলনার এক ব্যক্তির সঙ্গে একটি প্রাইভেট কার নিয়ে ঝামেলা হলে তারা যশোরে এসে বাসা ভাড়া নেয়।

গত ২৭ জানুয়ারি রাজের জন্মদিনে মদ ইয়াবার পার্টি আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে রিতুও রাতভর মদ-ইয়াবায় ডুবে থাকে। ওই রাতেই রিতু বলে এক আইনজীবীর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বড়লোক। অনেক টাকা-পয়সা আছে। তাকে অপহরণ করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তখন ওই বাসায় বসেই রিতুর হবু স্বামীকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করে তারা। রিতুর হবু স্বামীকে অপহরণ করে যে টাকা পাওয়া যাবে সেগুলো দিয়ে তারা একটি পুরাতন এলিয়ন গাড়ি কিনবে। সাজেকে ঘুরতে যাবে। তখন তারা পরিকল্পনা করে। আইনজীবীকে অপহরণ করে মেরে ফেলারও পরিকল্পনা করেছিল তারা।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা থেকে খুলনায় যান আবু হেনা মোস্তফা। উদ্দেশ্য হবু স্ত্রী রিতুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। রিতু তাকে খুলনা পাইওনিয়ার কলেজের সামনে যেতে বলেন। সেখানেই দেখা হয় তাদের। খুলনা এলাকায় অবস্থানকালে রেস্টুরেন্টে বসে ফোনে কথা হয় রিতুর বান্ধবী নীলের সঙ্গে। মডেল নীল বাসায় আমন্ত্রণ করেন হবু দম্পতিকে। আবু হেনা মোস্তফা অচেনা কারও বাসায় যেতে আগ্রহী না। মডেল নীল তাকে দুলাভাই সম্বোধন করে জানান, এতো কাছে এসে চলে যাবেন শ্যালিকাকে দেখবেন না, তাতো হয় না। মোস্তফা জানান, অন্য একদিন আসবেন। বাসায় যাবেন। দীর্ঘ সময় আড্ডা দেবেন। মডেল নীল নাছোড়বান্দা। এক পর্যায়ে মডেল কন্যা নিজেই উপস্থিত হন।

বান্ধবী ও তার হবু স্বামীকে বাসায় নিয়ে যেতে চান তিনি। আবু হেনা মোস্তফা ও রিতু তখন জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পার্কে। অল্প সময়েই মোস্তফার কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করেন। রিতু তার খুব কাছের বান্ধবী। সুতরাং বাসায় গিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেবেন। রাজি হন মোস্তফা। নীলের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যশোর জেলার অভয়নগরে একতাপুর। সেখানে ভাড়া বাসায় রাজকে নিয়ে থাকেন নীল। সমবয়সী রাজকে সবাই তার স্বামী হিসেবেই জানেন।

বাসায় যাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই ঘটে ঘটনাটি। বাসার দরজা-জানালা বন্ধ। কথা বলার মধ্যে বারবার উঠে যাচ্ছিলো নীল ও রিতু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ বদলে যায় তাদের রূপ। হঠাৎ করেই আবু হেনা মোস্তফাকে চেপে ধরে তারা। দড়ি এগিয়ে দেন মডেল নীল। মুখ চেপে ধরেন। দ্রুত মোস্তফার হাত-পা বাঁধে তারা। লুটে নেয় তার সঙ্গে থাকা সর্বস্ব। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয়া হয়। তারা যা বলবে তাই করতে হবে। নতুবা মেরে লাশ গুম করা হবে।

সন্ধ্যায় আবু হেনা মোস্তফাকে বাধ্য করা হয় তার বন্ধুকে কল দিতে। তিনি বন্ধু হাফিজকে কল দিয়ে জানান, তিনি খুব বিপদে। এক্ষুণি টাকার দরকার। হাফিজ বিকাশে টাকা পাঠান।

পরে পরিচয় গোপন করে আবু হেনা মোস্তফার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে পর্যায়ক্রমে তার পিতা এবং দুলাভাইকে ফোন করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এই চক্র। এ সময় মোস্তফাকে মারধর করে কান্নার আওয়াজ শুনানো হয় স্বজনদের। জিম্মি থেকে মারধর, মুক্তিপণ আদায় পুরো কাজটাই করছিল সুরাইয়া নীল, তার স্বামী রাজ ও চক্রের অন্যান্য সদস্যরা। উপায়ন্তর না পেয়ে এই আইনজীবীর পরিবারের সদস্যরা আশ্রয় নেন পিবিআইর।

পরে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের দিক-নির্দেশনায় পিবিআই যশোর জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার রেশমা শারমিনের নেতৃত্বে একটি টিম মাঠে নামে। মুক্তিপণের টাকা নেয়ার সময় গ্রেপ্তার করে চক্রের শাহীন শিকদারকে। পরে তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে অভয়নগর থানার একতাপুর থেকে গ্রেপ্তার করে আব্দুস সালাম ও সুরাইয়া নীলকে।

[media type="image" fid="109968" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

ওই বাড়ি থেকেই রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা অপহৃত আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা মলিনকে। অপহরণের দুইদিন পর গত মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) তাকে উদ্ধার করা হয়। এক মাস আগে ওই বাড়িতে অভিযুক্ত সুরাইয়া নীল ও আব্দুস সালাম স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছিল।

পিবিআই যশোর জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন বলেন, সুরাইয়া নীল, রাজ, রিতু চাকচিক্য ও বেপরোয়া লাইফ কাটাতে পছন্দ করতো। কিন্তু তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। শুধু বেপরোয়া রাজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। রিতুর বাবাও একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। তিনি নিজে অনার্সের শিক্ষার্থী। বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে বের হতেন। তারা ভুক্তভোগী আইনজীবীকে অপহরণ করে অনেক টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তাকে মেরে ফেলারও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পিবিআই তার আগেই এই চক্রের রিতু ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে। খুব শিগগির রিতুকেও গ্রেপ্তার করা হবে। ঘটনার পর থেকে রিতু ও রাজ পলাতক রয়েছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ২০ বছর বয়সী সুরাইয়া নীল র‌্যাম্প মডেল হিসেবে পরিচিত। অভিনয় করেছেন টিভি নাটক ও সিরিয়ালে। নাটকে তাকে বিভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে। তবে তার বাস্তবের চরিত্র ভয়ঙ্কর। রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হতে বেছে নেন ভিন্নপথ। ব্ল্যাকমেইল থেকে শুরু করে মাদক বাণিজ্য। অপকর্মে ষোলআনা পূরণ করতে এই মডেল গড়ে তুলেছেন এক অপহরণকারী চক্র।

আমারসংবাদ/জেআই