এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৯:৪০ এএম
আধা বয়সী এই প্রতারককে দেশের আলোচিত অপরাধী সাহেদের সাথে তুলনা করেছেন ভুক্তভোগীরা। ভিআইপি ব্যাক্তিদের সাথে জরুরি মিটিংয়ে আছি বলে পাওনাদারদের দীর্ঘকাল ঘুরিয়ে চলছেন বহাল তবিয়তে। ফরিদপুরের আলোচিত এই ব্যাক্তির নাম হায়াত খান ওরফে মো. নাজমুল ইসলাম খান। দিনে দিনে তার প্রতারণার জাল ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জসহ সারাদেশে।
বাকপটু এই হায়াতের কাগজপত্রে দুই রকম নাম পাওয়া যায়। তিনি ফোনও ব্যবহার করেন একাধিক। অপরিচিত কারও ফোন ভুলেও ধরেন না, এমনকি পরিচয় দিয়ে মেসেজ দিলেও না। নানান ব্যবসার পার্টনার বানানোর কথা বলে বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হায়াত খান, কিন্তু এরপর থেকেই পাল্টে যায় তার সুর। 'ব্যস্ত আছি', 'মিটিংয়ে আছি', 'আপনার বিষয়টি নিয়েই কাজ করছি...' এ জাতীয় নানা বাহানা দিয়ে পাওনাদারদের সাথে শর্তভঙ্গ করে চলেছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হায়াতের আদি বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার জোনাশুর ইউনিয়নের সমসপুর গ্রামে। তার ২৯২৪৭০৪১৩৪১১৪ নম্বর জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নাম আব্দুল ওহাব খান ও মাতার নাম নুরজাহান বেগম। সেখানে অস্থায়ী ঠিকানা ফরিদপুর শহরের পূর্বখাবাসপুর লেখা থাকলেও বর্তমানে থাকেন অন্যত্র। হায়াত দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন।সৌদি আরবের কিং ফাহাদ হসপিটালে চাকরি করতেন।দেশে ফেরার পর থেকে গত এক যুগে তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকজন।
এই প্রতারকের ১৯৮২ সালের ইস্যুকৃত পাসপোর্ট নম্বর ই-০৬৪৩৮৩-তে তার নাম নাজমুল ইসলাম খান, অথচ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইস্যু হওয়া নতুন পাসপোর্টে তার নাম হায়াত খান উল্লেখ করা হয়েছে। তার স্ত্রী সাবিরা রেজার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বামীর নাম লেখা আছে হায়াত খান। ওদিকে তার মেয়ে খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক সুমাইয়া খানের জাতীয় পরিচয়পত্রে এবং ছেলে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সাবিরুল খানের জন্ম নিবন্ধনে বাবার নাম নাজমুল ইসলাম খান উল্লেখ রয়েছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ফরিদপুর জেলা শাখার সভাপতি বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এম এ জলিল বলেন, এই হায়াত খান প্রতারণার দিক দিয়ে প্রতারক সাহেদের থেকেও পুরোনো ও কৌশলী। ব্যবসার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নিয়েছিল বছর দশেক আগে। অনেক দিন ঘুরানোর পর তৎকালীন আমার সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ছেলের সহায়তায় ও র্যাবের মধ্যস্থতায় অনেক চেষ্টা করে টাকা ফেরত পেয়েছি। তার কাজই মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। তার স্বরূপ উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন,যাতে নতুন করে আর কাউকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে না পারে।
কাশিয়ানীর গোয়ালগ্রামের হুমায়ূন মুনশীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তার চাচা স্কয়ার টেক্সটাইল মিলের সাবেক ডেপুটি ম্যানেজার শাহওয়ার্দী মুনশীর কাছ থেকে দুই দফায় ৯ লক্ষ টাকা নিয়েছেন এই হায়াত খান। চাকরিও দিতে পারেননি, ফেরত দিচ্ছেন না টাকাও।
শাহওয়ার্দী মুনশী এ ব্যাপারে বলেন, জমি বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে দুই বছর ধরে আমাকে ঘোরাচ্ছেন হায়াত খান। কোনো টাকাই এখনো ফেরত পাইনি।
গত ৫ আগস্ট পুলিশ সুপারের কাছে দেওয়া এক লিখিত অভিযোগে ফরিদপুর সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, তার কাছ থেকে এক্সিম ব্যাংকের দুইটি চেকের মাধ্যমে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা নিয়ে এখন লাপাত্তা হায়াত খান। ফোনও ধরেন না, ফরিদপুরে তার বাসায় যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর মেলেনি।
প্রভাষক মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি হায়াতের ভাই ও ভাতিজারা আমেরিকায় থাকেন। বহু মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে নেওয়া বিপুল অর্থ নিয়ে হায়াত এখন আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি পাসপোর্টে মালয়েশিয়ার ভিসা লাগিয়ে সম্প্রতি দেশটি ঘুরে এসেছেন। আমাদের টাকা মেরে দিয়ে হায়াত যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেজন্য ফরিদপুরের আদালতে আমি তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা করেছি। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের জজ কোর্টে ওই মামলার শুনানির দিন ধার্য আছে।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ঘিকমলা বাজারের দর্জি আব্দুল হান্নান মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন,তার সাথে ৪ বছর আগে পরিচয় হয় হায়াত খানের। বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া বাজারে এবং কালুখালী থানাধীন মৃগী ও লাড়িবাড়ী বাজারে যাওয়া আসা ছিল হায়াতের। স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে তিনি নারুয়া বাজারের পাট ব্যবসায়ী হুমায়ূনের সাথে হায়াতের টাকা লেনদেন সংক্রান্ত ঝামেলায় মধ্যস্থতা করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই নারুয়া থেকে মৃগী বাজারে যাওয়ার পথে স্থানীয় ঘিকমলা বাজারে তার কাপড়ের দোকানে প্রায়ই বসতেন হায়াত।
ঘনিষ্ঠতার একপর্যায়ে হায়াত তার নিজস্ব লোক মারফত তাকে ভালো উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের ভিসা দেওয়ার প্রলোভন দেখান। বিদেশে যাওয়ার অভিপ্রায়ে গত বছরের অক্টোবরে পাসপোর্টও করেন হান্নান। ভিসা বাবদ হায়াতকে দেন ৬ লাখ টাকা। পরে দেখা যায় সেটা ভুয়া ভিসা। তারপর থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে এক বছর ধরে তাকে ঘোরাচ্ছেন হায়াত।
এই প্রতারক ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে গ্রিসে পাঠানোর কথা বলে ঢাকার মিলন আহম্মেদ, কাজী জাকির হোসেন, শাহীদুল ইসলাম, দীপক কুমার বিশ্বাস ও রহমতুল্লাহ রণি নামের ৫ ব্যাক্তির কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ঢাকার রাজারবাগের ৯৫৬/২ আউটার সার্কুলার রোডস্থ আশরাফ রিয়েল এস্টেটের রুস্তম আলী মোল্লার মাধ্যমে ২০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে হয় এই লেনদেন।
তারপর ১২ বছর ঘুরে টাকা ফেরত না পেয়ে অবশেষে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ৫ ব্যক্তির পক্ষে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা রুস্তম আলী মোল্লা। তিনি বলেন, চলমান এই মামলা তুলে নিতে বাদীপক্ষকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন হায়াত খান।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলীর ব্যাপারি ভিলার বাসিন্দা হায়াত খান ওরফে মো. নাজমুল ইসলাম খানের সাথে তার তিনটি নম্বরে একাধিবার ফোন করে ও মেসেজ দিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে তার স্ত্রী সাবিরা রেজা বলেন, তার স্বামী বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন, ৬ মাস হলো তিনি ফরিদপুরের বাসায় আসেননি। তার বিরুদ্ধে আনিত সকল প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবিরা বলেন, তার (স্বামী) সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার জন্য জানানো হবে।
ফরিদপুর ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুনীল কর্মকার এই বিতর্কিত ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, এর আগে আমি আমার পরিচয় দিয়ে তার (হায়াত খান) সাথে মোবাইলে কথা বলতে চাইলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে পরে ফোন দিতে বলেন। জেনেছি, বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।
সুনীল কর্মকার আরও বলেন, তার ব্যাপারে আমাদের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।
আমারসংবাদ/কেএস