Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

একটি হামলা একটি মামলা বদলে দিল ফরিদপুরের সব

এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর

মার্চ ৫, ২০২১, ০৩:০০ পিএম


একটি হামলা একটি মামলা বদলে দিল ফরিদপুরের সব

একটি মামলা। ফরিদপুর জেলার সবকিছু বদলে দিয়েছে। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন নয়, প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটা অঙ্গনেই বদলের চিত্র। বলা চলে এটি একটি অপশাসন-অপরাজনীতির সিন্ডিকেটের পতন। দীর্ঘদিন ধরে ভয়ের শহর, দখলের শহর, অপরাজনীতির শহরে পরিণত হয়ে ওঠে ফরিদপুর। এর আঁচ ছড়িয়ে পড়ে জেলা জুড়ে। নানান সব খারাপ কর্মকাণ্ডের মাত্রা ছাড়ানোর মধ্য দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে হামলাই যেন কাল হলো। এরপর মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলা। এই একটি হামলা আর একটি মামলা পুরো জেলার সব চিত্র-পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছে। 

জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ মতে, ২০১৭ সাল থেকে খন্দকার মোশাররফকে ঘিরে একটি চক্র তৈরি করে বরকত, রুবেল, এপিএস ফোয়াদসহ কয়েকজন। এ চক্রের দৌরাত্ম্য অব্যাহত থাকে গত বছরের জুন পর্যন্ত। 

গত বছরের মে মাসে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলা হয়। ওই হামলার মামলায় গত বছরের ৭ জুন বিশেষ অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরপরই ফরিদপুর ছাড়েন খন্দকার মোশাররফের অন্তত অর্ধশত অনুসারী।

ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গত বুধবার (৩মার্চ) আড়াই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। এই ১০ জনের সবাই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগপত্রে ৩ নম্বর আসামি হয়েছেন খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর। খন্দকার মোশাররফের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) এ এইচ এম ফোয়াদকে ৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে বরকত, রুবেলসহ চারজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বাকি ছয় আসামি পলাতক। 

এদিকে, ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই বরকত ও রুবেলের অপকর্মের দায় খন্দকার মোশাররফ হোসেন এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। জেলা কমিটির পাঁচজন নেতা বলছেন, দুই ভাই খন্দকার মোশাররফের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল। মূলত তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়েই দুই ভাই বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন। বিষয়টি ফরিদপুরের কারও অজানা নয়। 

এদিকে মুদ্রা পাচারের ওই মামলায় অপকর্মে জড়িত সবার নাম আসায় ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রশ্ন তুলেছেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে করা মামলার অভিযোগপত্রে খন্দকার মোশাররফের নাম কেন আসেনি, সে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, চার্জশিটে অনেকের নাম নেই। মনে হচ্ছে, এটি পূর্ণাঙ্গ চার্জশিট নয়। তদন্তের পর আরও অনেকের নাম যুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়। আর জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ঝর্ণা হাসান এই অভিযোগপত্রকে 'প্রশ্নবিদ্ধ' বলে উল্লেখ করে বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম আমরা শুনেছিলাম। কেন তাদের নাম এল না, তা বোধগম্য নয়।

সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এলজিইডির ৪৭৫টি ঠিকাদারি কাজ পান বরকত ও রুবেল, যার আর্থিক মূল্য ৮১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে দুই ভাইয়ের ৯টি ব্যাংকের ১৮৮টি হিসাবে ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। খন্দকার মোশাররফের প্রশ্রয়ে থেকেই চক্রটি ফরিদপুরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে ব্যাপক আকারে তদবির করে তাঁরা এই বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।

এ সব বিষয়ে বর্তমান সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন মুঠোফোনে সাংবাদিকদের জানান, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় আমার ভাইকে (বাবর) কেন যুক্ত করা হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। টেন্ডার হয় প্রকল্প পাসের মাধ্যমে। কোনো প্রকল্প প্রণয়নে বাবরের ভূমিকা থাকার কথা নয়। কোনো ঠিকাদারের টাকা বাবর তুলে নিয়েছে, এমন অভিযোগও নেই। আমার মনে হয়, এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, তবে বরকত ও রুবেল ঠিকাদার। প্রকল্প প্রণয়ন ও কাজের ক্ষেত্রে তাদের খবরদারি থাকতে পারে।

দলীয় রাজনীতির অবস্থা ভালো ঠেকছে না। সবাই নিজেকে বড় নেতা মনে করে। আমার অনেক বয়স হয়েছে। ৮০-৮২ বছর বয়সে এসে আর কোনো ভেজাল-গুঁতাগুঁতির মধ্যে থাকতে চাই না।

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, খন্দকার মোশাররফ এবং তাকে ঘিরে থাকা এই চক্রের সময়কালে জেলা আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতা-কর্মীদের যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তা বিরোধী দলের আমলেও কখনো হয়নি। নেতারা বলছেন, সিআইডির অভিযোগপত্রে মোশাররফ ঘনিষ্ঠ আরও অনেকের নাম আসেনি।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপুল ঘোষ বলেন, চার্জশিট দেখে হতাশ হয়েছি। কেননা, ফরিদপুরে যা কিছু হয়েছে, তার কিছুই মোশাররফ ও তার ভাই বাবরের কথার বাইরে হয়নি। মোশাররফের নাম নেই অথচ তার ভাই বাবরের নাম আছে, এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা।

আমারসংবাদ/কেএস