Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সিরাজগঞ্জে ডেইরী ফার্মে স্বপ্ন দেখছেন খামারিরা, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা

এপ্রিল ১০, ২০২১, ০৭:৪৫ এএম


সিরাজগঞ্জে ডেইরী ফার্মে স্বপ্ন দেখছেন খামারিরা, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা

সিরাজগঞ্জে বেকার যুবক থেকে শুরু করে এখন সব শ্রেণির মানুষই ঝুকছেন ডেইরী ফার্ম ও গরুর খামারে। অধিক লাভের পাশাপাশি নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে প্রতিটি পরিবারের। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পিছনে না ছুটে বা অন্য ব্যবসা ছেড়ে গড়ে তুলছেন নিজস্ব খামার, স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন অনেকদূর। 

এছাড়াও প্রতিটি ডেইরী ফার্মের খরচ সাধারণত উৎপাদিত দুধেই চলে যায়। সেস্থলে ফার্মে বড় হওয়া ষাড় ও বকনা বিক্রি করে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা আয় হয়ে থাকে।

জেলার সব উপজেলাতেই ব্যাপকভাবে গরুর খামার গড়ে উঠলেও সবচেয়ে বেশি ডেইরী ফার্ম গড়ে উঠেছে শাহজাদপুর উপজেলায়। 

শাহজাদপুরের হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নের শাহজাদপুর-জামিরতা সড়কের বেড়া কুচাটিয়া গ্রামের মো. সাকিম উদ্দিনের ছেলে মো. মনোয়ার হোসেন (৩৪)। বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। 

মনোয়ার কলেজ শেষ করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেও শেষ করা হয়নি। একপর্যায়ে শুরু করেন গার্মেন্টস ব্যবসা। পরবর্তীতে সেটিতে লাভ না হয়ে উল্টো লস হতে থাকলে একটি ডেইরি ফার্ম করেছেন প্রায় ১বছর হলো। এখানে প্রায় ৩০টা গরু আছে। 

এরমধ্যে ১৬টি গাভী বাদবাকি গুলো বকনা ও ষাড় বাছুর। ১৬টি গাভী থেকে প্রতিদিন পাচ্ছেন প্রায় ২০০লিটার দুধ। বকনা বাছুর ২ বছর পালনে আড়াই লক্ষাধিক টাকা বিক্রি করা যায়। এবং সেই বকনাটিই এর মাঝে একটি বাচ্চা দিবে। আর সেই বকনার পিছনে ২ বছরে খরচ হয় প্রায় ১ লক্ষ টাকা।

তিনি আমার সংবাদ'র প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে আরও জানান, ১৬টা গাভীর পিছনে প্রতিদিন তার খরচ হচ্ছে প্রায় (সবকিছু মিলিয়ে) সাড়ে ৫ হাজার টাকা।

৩০টা গরুর জন্য প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আর প্রতিদিন দুধ বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার টাকার মতো। প্রতি কেজি দুধ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪২টাকা। এছাড়া খামারে ষাড় বেড়ে উঠছে। 

যার পিছনে অতিরিক্ত খরচ করা লাগছে না। প্রতিটি বাচ্চা ষাড় যদি দেড় বছর লালন পালন করে বিক্রি করা যায় তাহলে তার পিছনে খরচ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আর বিক্রি করা যায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। 

তিনি আরও বলেন, খামারের আগে গার্মেন্টস এর ব্যবসা ছিল। কিন্তু সেটি ছেড়ে এখন গরুর খামারেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

তার মুন্না ডেইরী ফার্মে সবগুলোই অস্ট্রেলিয়ান জাতের জার্সি, শাহীয়াল, ফিজিয়ান হানড্রেড প্রজাতির গরু রয়েছে জানিয়ে বলেন, একবছরে খরচ হয়েছে প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা। আর খরচ বাদ দিয়ে বছরে অন্তত ১০-১২লাখ টাকা লাভ হবে।

মনোয়ারের পরিবারে আছেন বাবা মা ছেলে মেয়ে সহ ছয়জন। পরিবার নিয়ে সুখেই আছেন তিনি। তাছাড়াও পাঁচটি পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে।

এছাড়াও শাহজাদপুরের আরও দুজন ডেইরী ফার্মের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র ৪-৫ বছরের ব্যাবধানে ৫০-৬০টি গরু পালনে তারা আয় করেছেন প্রায় ৪০লক্ষ টাকা। 

পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এলাকার অসংখ্য মানুষের। তাছাড়াও এলাকায় দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সারে দেশে তা চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের শাইলদাড় গ্রামের এস.এম ফেরদৌস রহমান, ঢাকায় একটি ব্যবসা করলেও নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন রহমান এগ্রো কমপ্লেক্স নামে একটি ডেইরী ফার্ম। ২০টি গরুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা খামারে ১০টি গাভী, ৬টি বকনা ও ৪টি ষাড় রয়েছে। 

আমার সংবাদকে ফেরদৌস রহমান জানান, আমি আগামীতে প্রায় ১৫বিঘার উপরে বৃহৎ আকারে এগ্রো কমপ্লেক্স করবো। সেখানে কয়েকশত গরুর পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হবে। 

[media type="image" fid="119344" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা সবাই আমার সংবাদকে জানান, তাদের স্বপ্নের কথা। কেউ শখের বসে আবার কেও বানিজ্যিকভাবে গরু পালন শুরু করলেও পেশা হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন সবাই। আগামীতে স্বপ্ন দেখেন আগামী ৪-৫ বছরে সবারই শতাধিক করে গরু হবে, আয় বাড়বে কয়েকগুণ। পাশাপাশি অন্তত ৩০০ টি পরিবারের কর্মসংস্থান হবে। 

এছাড়াও তারা বেশিরভাগই বলেন, প্রথমত প্রশিক্ষণ নেয়া হয়নি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন পূরণে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ এখনো নেন।

সবাই আমার সংবাদকে বলেন, আমার মনেহয় একজন সফল খামারী হতে আগে প্রশিক্ষণ ও সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাছাড়াও শুরুতে গরু কিনতে সতর্ক থাকতে হবে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে। সঠিক পরিচর্যা ও খাবারের সঠিক সমন্বয় থাকতে হবে। প্রাণী সম্পদ অফিসের পরামর্শ নিতে হবে। এবং সঠিক জায়গা নির্বাচনও একটি বড় ব্যাপার। খোলামেলা সুন্দর জায়গা হলেই উত্তম।

তাছাড়াও প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে গিয়ে জানান, রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়ও নিয়মিত টিকা দিতে হয়। এছাড়াও পোকামাকড়ের ভয় ও নানান ভয়তো কাজ করেই।

দুধ বিক্রির বিষয়ে তারা বলেন, মিল্ক ভিটা সহ যেখানে রেট বেশি পাই সেখানেই বিক্রি করি। এখন স্থানীয় একটি কারখানায় বিক্রি বেড়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, কারখানায় দামটা একটু বেশি পাওয়া যায়।

জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের তথ্যানুযায়ী, জেলায় সর্বমোট ডেইরী ফার্ম আছে ২৪ হাজার ১৯৩টি। বছরে জেলায় দুধ উৎপাদন হচ্ছে ৭ লক্ষ ৪৫ হাজার মেট্রিকটন। এর মধ্যে শুধু শাহজাদপুরেই ১ লক্ষ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। 

তবে কোন উপজেলায় কয়টি ডেইরী ফার্ম আছে সেই হিসাব জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে হালনাগাদ তথ্য নেই বলে জানান অফিস সহকারী মোছা. রেবেকা খাতুন। এছাড়াও বছরে মাংস উৎপাদন হচ্ছে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন।

সার্বিক বিষয়ে মিল্ক ভিটার ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ লাভলু আমার সংবাদকে বলেন, মিল্ক ভিটা বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে তৈরি একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। যেটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত। 

মিল্ক ভিটা শুধু দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় চাহিদাই পূরণ করছেনা, এর পাশাপাশি সকল খামারিদের বা ডেইরী ফার্ম গুলোকে সার্বিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। আমরা তাদেরকে নূন্যতম ২-৩% এ লোন দেয়ার পাশাপাশি নিজস্ব ডাক্তার দ্বারা গরুর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বিনামূল্যে গোখাদ্যের ব্যবস্থা করছি। 

এছাড়াও বন্যাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩০০ একর জায়গা আমরা গরু রাখতে ও খামার করার জন্য দিয়েছি। 

এছাড়াও দুধের মূল্যের ব্যাপারে বলেন, এখানে দুধের ফ্যাটের উপরে দাম নির্ধারণ করা হয়। কেও পানি মিশিয়ে যদি দুধ বিক্রি করতে চায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার দুধের দাম কেজিতে কম পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পাবনা বীজ নামে একটি বীজ আনেন যেখান থেকেই মূলত বৃহত্তর পাবনাতে উন্নত জাতের গরু ও গাভীর আগমন ঘটে। পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ড থেকে ষাড় আনা হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. আখতারুজ্জামান ভূইয়া আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সকল ডেইরী ফার্মে ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সার্বিক  চিকিৎসা দিচ্ছি। 

এখন কোনো জটিল রোগ নেই। মৃত্যুহার শূন্যতে নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় উঠান বৈঠক করে সচেতনতা তৈরি করছি। এছাড়াও বন্যার সময়ে আমরা বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে থাকি। এছাড়াও গরু পালনে ৩ভাগের ২ভাগই লাভ হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, যেহেতু গরুর খামার ও ডেইরী ফার্মে বেশি প্রযুক্তি ব্যাবহারের প্রয়োজন হয়না এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করলে লছের সম্ভাবনা নেই ও অধিক লাভবান হওয়া যায়। 

তাছাড়াও উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বপ্ন দেখছে অসংখ্য পরিবার। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করতে পারছেন। 

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই এব্যাপারে প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থার মাধ্যমে অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং অনেকেই এখনো নিচ্ছেন। 

[media type="image" fid="119345" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নামক একটি প্রকল্প ইতিমধ্যেই এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও আমরা ৪% সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। এই সম্ভাবনাময় সেক্টরটি আগামীতে আরও এগিয়ে যাবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

আমারসংবাদ/এআই