Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

স্বাস্থ্যবিধি মানলেও দুর্ভোগে পোশাক শ্রমিকেরা

মাসুদ রানা, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি

এপ্রিল ১৫, ২০২১, ১১:৫৫ এএম


স্বাস্থ্যবিধি মানলেও দুর্ভোগে পোশাক শ্রমিকেরা

করোনা সংক্রমণ রোধে সারাদেশে শুরু হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ, যা চলবে আগামী ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত। সরকার ঘোষিত এই নিষেধে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও শুধু খোলা রয়েছে জরুরি সেবাদানকারী পরিবহন, ব্যাংক ও পোশাকশিল্প কারখানা। 

এসব কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কারখানা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিবহন সরবরাহের কথা থাকলেও পায়ে হেঁটে কারখানায় যেতে হচ্ছে অনেক শ্রমিকদের। এতে করে একদিকে শ্রমিকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। 

অন্যদিকে, অটোরিকশায় গাদাগাদি করে যাওয়ায় বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি। তবে কারখানায় আসা যাওয়ার জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার কথা থাকলেও তা রয়েছে উপেক্ষিত।

গাজীপুর জেলা শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে তিন হাজারের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করছেন লাখ লাখ শ্রমিক। সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারের ১৩ দফা নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর, কোনাবাড়ী, টঙ্গী, পোড়াবাড়ি, সালনাসহ জেলার শুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। 

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় শ্রমিকদের মাস্ক পরা, শরীর জীবাণুমুক্তকরণ, হাত ধোয়া সহ প্রত্যেক শ্রমিকের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা নেয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রিকশা, অটো রিকশা ও পাঁয়ে হেঁটে কারখানায় আসছেন শ্রমিকেরা।

গাজীপুর জেলা শিল্প পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গাজীপুরে ২ হাজার ৭২টি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এদের মধ্যে বিজিএমইএ’র আওতাভূক্ত ৮৩০টি, বিকেএমইএ’র ১৩৮, বিটিএমইএ’র ১২২ এবং অন্যান্য কারখানা রয়েছে ৯৮২টি। শুধুমাত্র সিটি এলাকায় অবস্থিত কারখানায় কাজ করছেন অন্তত ২২ লাখ শ্রমিক। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে এসব শ্রমিকরা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কড়ইতলা এলাকার ডিজাইটেক্স কারখানার নারী শ্রমিক রেহেনা আক্তার বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শরীরের তাপমাত্রা মাপা, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক দূরত্বের জন্য মালিকপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। জীবন ও জীবিকার জন্য কারখানায় কাজ করতে চান তারা।

নারী শ্রমিক খাদিজা আক্তার বলেন, আমরা তো গার্মেন্টস শ্রমিক। এক কারখানায় প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করি। সবাই পৃথক বাড়িতে ভাড়া থাকি। কার বাড়িতে কার যাতায়াত এটা বলা কঠিন। করোনা সংক্রমণের রোগী যদি কোনো এক বাড়িতে আসে তাহলে আমাদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। করোনার ঝুঁকি নিয়েই ভয়ে ভয়ে কারখানায় যাচ্ছি। আমাদের সবার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নেই।

সাদমা গ্রুপের পরিচারক সোহেল রানা বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ঠেকাতে কারখানায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জীবন এবং জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারখানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের তাপমাত্রা মাপা, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে প্রবেশ করানো, জীবানুমুক্ত করণ ও হাতধোয়াসহ আক্রান্ত হলে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

চারটি হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাব। এভাবে আমরা শ্রমিকদের সার্বক্ষনিক নজরে রেখেছি, যাতে সুষ্ঠুভাবে কারখানা পরিচালনা করতে পারি।

শ্রীপুরের ডেনিমেক পোশাক কারখানার রফিকুল ইসলাম বলেন, লকডাউন হলেই অফিস যেতে সমস্যা হয়। গাড়ি পাওয়া যায় না, রিকশাভাড়া ডাবল হয়ে যায়। আমাদের খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু কারখানা কিংবা সরকার তো এই টাকা আমাদের দেবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সালনা এলাকার প্যারাগন ড্রেস লি: কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে কারখানা পরিচালনা করছেন তারা। আর কর্মরত শ্রমিকেরাও তাদের জন্য নেওয়া এসব ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করছেন। শ্রমিকদের সুরক্ষায় শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। 

কল্লোটেক্স অ্যাপারেলস্ লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার এবং বিজিএমইএ’র নির্দেশনা মেনে কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে মালিক পক্ষ। গত লকডাউনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে করোনা মোকাবিলায় এবার কারখানা পরিচালনা করছেন তারা। কিন্তু শ্রমিকেরা পরিবহন নিয়ে যে দুর্গতি পোহাচ্ছেন, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি কর্তৃপক্ষ।

মৌচাক নিট কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি কীভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে শ্রমিকদের সচেতন করা যায়। এজন্য প্রতিনিয়ত কাউন্সিলিং হচ্ছে, তারাও আগের তুলনায় সচেতন রয়েছে। গত লকডাউনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার আমাদের কারখানা পরিচালনা করা তুলনামুলক সহজ। এজন্য সহজে আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিজেরা করতে পারছি।

বিজিএমইএ পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, শ্রমিক সুরক্ষাসহ কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বিজিএমইএ’র পক্ষে ১২টি টিম কাজ করছে। আমরা চাই শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখতে। এজন্য ১২টি টিম প্রত্যেকটি কারখানায় নিশ্চিত করবে প্রয়োজনী মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি। কোনো কারখানা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিজস্ব পরিবহনে শ্রমিকদের আনা-নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের শ্রমিকদের ৮০ ভাগ কারখানার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করেন। তারা পায়ে হেঁটেই কারখানায় আসতে পারছেন। আর অফিসার, মার্চেন্ডাইজার, স্টাফ যারা আছেন তারা নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় কারখানায় আসছেন। কোনো শ্রমিক বা কর্মী পরিবহন ব্যবহার করে কারখানায় যাবে না।

[media type="image" fid="120017" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

শ্রীপুর আঞ্চলিক শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জালাল আহমেদ বলেন, বড় বড় কিছু কারখানার আগে থেকেই পরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে করে দূরের শ্রমিকরা যাতায়াত করে থাকে। কিন্তু নতুন করে কোনো কারখানা পরিবহনের ব্যবস্থা করেছেন বলে এখনও খবর পাইনি।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) সুশান্ত সরকার বলেন, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য জোন ভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিল্প পুলিশ ছাড়াও জেলা প্রশাসন, কলকারখানা অধিদপ্তর, মেট্টোপলিটন পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। কোনো কারখানার মালিক যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন তবে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করব।

আমারসংবাদ/এআই