Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

যশোরে তৈরি হচ্ছে বাস ও ট্রাকের বডি 

এম এ রহমান যশোর 

জুন ৪, ২০২১, ০১:২০ পিএম


 যশোরে তৈরি হচ্ছে বাস ও ট্রাকের বডি 

যশোর শহরের মণিহার সিনেমা হলের সামনে দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগোলেই বকচর এলাকা। এখান দিয়ে চলে গেছে যশোর-খুলনা রোড। বকচর এখানকার বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং-এ কাজ করছেন ২৫/২৬ জনশ্রমিক। পাশের রাস্তা দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে রং-বেরঙের নামি-দামি অসংখ্য যানবাহন। কিন্তু সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। কারো হাতে হাতুড়ি, কেউ ব্যস্ত ওয়েল্ডিং-এ। কারখানার দু’পাশে পড়ে রয়েছে বিশাল আকারের একপি বাস ও ট্রাকের বডি স্ট্রাকচার। দুটির জন্য কাজ করছেন তারা।

কথা হয় বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং এর মালিক মো. বাবু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, পার্টির তাগাদা আছে, বডি দুটি দ্রুত তৈরি করে দিতে হবে। তাই সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এ দুটি শেষ করার পর আরও দুটি বডি তৈরির কাজে হাত দিতে হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শুধু বাংলাদেশ ওয়াল্ডিং নয়, যশোরে এ ধরনের ছোট-বড় অন্তত দেড় হাজার অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে বর্তমানে বাস-ট্রাকের বডি তৈরি হচ্ছে। যশোরের অভিজ্ঞ মিস্ত্রিরা তৈরি করছেন বিদেশের আদলে অত্যাধুনিক হিনো, ভলভোও আরএম-টু বাসের বডি। যা বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভাব।

শুরুর কথা: 
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান আমলের শুরুতে যশোরে বাস ট্রাক চলাচলের প্রসার শুরু হয়। অবাঙ্গালীরা শহরের মিস্ত্রিখানা রোডে ছোট্ট পরিসরে মোটর গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ গড়ে তোলে। সেই থেকে শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর সড়ক পরিবহনে যশোরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। বাস, ট্রাক, মাইক্রো, কারসহ বিভিন্ন যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যশোর সড়ক পরিবহনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।

সে সাথে গাড়ি মেরামতের জন্য গ্যারেজের চাহিদাও বেড়ে যায়। গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন মোটর গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ। ৯০ দশকের প্রথম দিক থেকে যশোরে অটোমোবাইল ব্যবসা শুরু হয়। ৮০ এর দশকের দিকে বাংলাদেশে হিনো গাড়ির আমদানি শুরু হলে অটোমোবাইল ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। তখন শুধু ঢাকাতেই বডি  তৈরি হতো। ঢাকার ড্যান্সো ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম পর্যায়ে বডি তৈরির কাজ শুরু করে। পরে নাভানা মটরসও গাড়ির বডি তৈরিতে হাত দেয়।

পরবর্তীকালে ভারত থেকে টাটা এবং অশোক লেল্যান্ড গাড়ি আমদানি শুরু হলে দেশে বডি তৈরির বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়। আর এই ৯০ দশকের শুরুতে আব্দুল মান্নান নামে এক অটোমোবাইল শ্রমিক যশোরে গাড়ির তৈরি শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। আব্দুল মান্নানের দেখা-দেখি আস্তে আস্তে এ পেশায় আসেন বাবু, জাহাঙ্গীর আলম, শাহিন কবির, কামাল হোসেন, মনোরঞ্জন প্রমুখ।

বর্তমানে যশোরে ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির রেজিস্ট্রেশনকৃত ওয়ার্কশপের সংখ্যা ৮০০ হলেও জেলা ও উপজেলা মিলিয়ে ওয়ার্কশপের সংখ্যা প্রায় হাজার দেড়েক হবে। আর এতে অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ এর সঙ্গে জড়িত।

দেশে যে পরিমাণ গাড়ির বডি তৈরি হয় তার বড় একটি অংশ হয় যশোরেই। এখানে তৈরি বডির মান ভালো এবং খরচ কম হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহর থেকে গাড়ির মালিকরা যশোরেই আসেন বডি করতে। এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে প্রতি মাসে একশ’ বাস এবং দেড়শ ট্রাকের বডি তৈরি হচ্ছে। এর পরিমাণ প্রতিবছরে গড়ে ১ হাজার ২০০ বাস এবং ১ হাজার ৮০০ ট্রাক। এতে লেনদেন হয় অন্তত ৩০০ কোটি টাকা।

দরদাম:
যশোর অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতি থেকে জানা যায়, যশোরের তৈরি বডি দেশের সেরা। এ জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মালিকরা এখানে আসেন। অন্যান্য জেলার তুলনায় কম খরচে এখানে কাজ হয়। ঢাকায় ওয়ার্কশপে একটি হিনো গাড়ির বডি তৈরি করতে খরচ হয় ১৩ লাখ টাকা। অথচ যশোরে তা সম্ভব ৮ লাখ টাকায়। একইভাবে ১৫১২ মডেলের একটি গাড়ির বডি করতে ঢাকাতে নেওয়া হয় সর্বনিম্ন ১২ লাখ টাকা। যশোরে তা করে দেওয়া হচ্ছে ৭ লাখ টাকায়।

একটি মিনিবাসের বডি করতে ঢাকায় খরচ হয় ৮ লাখ টাকা। যশোর তা করা সম্ভব ৫ লাখ টাকায়। এবাবে ট্রাকের বডি করতে ঢাকায় ৪ লাখ টাকা নেওয়া হলেও যশোরের মালিকরা তা করে দিচ্ছেন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। ঢাকায় কাভার্ড ভ্যানের একটি বডি করতে নেয় ৫ লাখ টাকা। যশোরে তা করা হচ্ছে মাত্র ৩ লাখ টাকায়। খরচ অনেক কম, সেই সঙ্গে উন্নতমানের বডি পাওয়ায় অনেকেই ছুটে আসেন যশোরে।

মালয়েশিয়া থেকে একটি মার্সেডিজ বেঞ্চ এর বডি আনতে খরচ হয় দেড় কোটি টাকা। তা যশোরে এক কোটি টাকাতে করা সম্ভব। এজন্য শুধু প্রয়োজন সুযোগ। আরও জানা যায়, এক কোটি টাকা হলে একটি হেলিকপ্টার বডি বানিয়ে দেওয়া সম্ভব।

যশোরে শুধু বাস-ট্রাকের বডি নয়, দীর্ঘদিন ধরে রি-মডেলিং এর কাজ হচ্ছে। যেসব গাড়ির বডি নষ্ট হয়ে গেছে তাদের মালিকরা গাড়ির-মডেলিং করে আবার স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করছেন। চমৎকার ফিনিশিংয়ের কারণে সারাদেশেই যশোরের তৈরি বডির কদর রয়েছে।

আরও যেসব কাজ হচ্ছে:
জানা গেছে, শুধু বডি নয়, যশোরের ওয়ার্কশপ গুলোতে ট্রাকের কেবিন, ডালাসহ ডেন্টিং এবং পেইন্টিংয়ের কাজও হয়ে থাকে। এছাড়া এখানকার লেদগুলোতে, ডবেনসোল, ফরেন এক্সেল, নাকাল, হপস্, চাকার ড্রাম, কাটিং সেপ, তেল ক্রাউন, ইঞ্জিন পুলি, আইডিয়াল পেনিয়াম, স্টারিং বক্স, স্টারিং হুইল, পাতির সেটের বুশ, ফ্রাই বেল্ট, পেশার প্লেট, হাউজিং, গিয়ারবক্স, ক্লাস প্লেট, ড্রাম, এক্সেল, রিং, হুইসিলিন্ডার, মাস্টার সিলিন্ডার, ক্লাস কানেকটিং, বাইসেক্টর প্রভৃতির কাজও দেশসেরা। এজন্য সারা বছর এখানকার শ্রমিকরা ব্যস্ত থাকেন।

আমারসংবাদ/এমএস