Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

বরিশালে এএসপি-ওসি-পরিদর্শকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

জহির খান, বরিশাল:

জুলাই ৬, ২০২১, ০১:৩৫ পিএম


বরিশালে এএসপি-ওসি-পরিদর্শকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

হত্যা মামলার একমাত্র আসামিকে (নারী) শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠায় বরিশাল জেলা পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার এবং উজিরপুর থানা পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে।

মামলার বিষয়টি মঙ্গলবার (৬ জুলাই) সকালে নিশ্চিত করেছেন উজিরপুর মডেল থানার নবাগত পরিদর্শক (তদন্ত) মমিন উদ্দিন। এর আগে গত রোববার (৪ জুলাই) ওই নারী আসামি বাদী হয়ে উজিরপুর মডেল থানায় সহকারি পুলিশ সুপার (উজিরপুর সার্কেল) আবু জাফর মো. রহমাতুল্লাহ, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল আহসান ও পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাইনুল ইসলামসহ ছয়জনের নামে মামলাটি দায়ের করেন।

তার আগে গতকাল সোমবার (৫ জুলাই) দুপুরে উজিরপুর মডেল থানার ওসি জিয়াউল আহসান ও পরিদর্শক (তদন্ত) মাইনুল ইসলামকে উজিরপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।

বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন জানান, ওই নারীর অভিযোগটি আদালতের মাধ্যমে পুলিশ সুপার কার্যালয় ও উজিরপুর থানায় পাঠানো হয়। এরপর (সেই অভিযোগটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে-বরিশালে রিমান্ডে নারী আসামিকে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে কমিটি)। পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে ওসি জিয়াউল আহসান ও পরিদর্শক (তদন্ত) মাইনুল হোসেনকে উজিরপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৬ জুন উজিরপুর উপজেলার জামবাড়ি এলাকা থেকে বাসুদেব চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার ছোট ভাই বরুন চক্রবর্তী ওই দিনই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এক নারীকে আসামি করা হলে ওই দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিহত বাসুদেব চক্রবর্তী স্থানীয় হারতা ইউপির ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য নিখিল চক্রবর্তীর সহোদর ছিলেন। পরবর্তীতে পুলিশ আদালতের কাছে পুলিশের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ জুন বরিশালের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উজিরপুর আমলী আদালত ওই নারী আসামির দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ড শেষে গত ২ জুলাই ওই নারীকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় তাকে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে আদালত ওই নারীর কাছে খুড়িয়ে হাঁটার কারণ জানতে চান। পরে ওই নারী আদালতের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে তাকে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন।

তখন আসামির অভিযোগ আমলে নিয়ে একজন নারী কনস্টেবল দিয়ে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মাহফুজুর রহমান ওই নারীর শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়। এরপর আদালত ওই নারীকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি নির্যাতন এবং হেফজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নির্যাতনের চিহ্ন ও নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের পরিচালককে নির্দেশ দেন।

পরে হাসপাতালের পরিচালক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই নারীর দেহে যে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা গত ১ জুলাই সকাল ১০টার দিকে হয়েছে। তার দুই হাতের কনুই, অস্থিসন্ধি এবং গলাসহ চারটি স্থানে পেটানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। শক্ত কোনো লাঠি বা সেরকম কিছু দিয়ে পেটালে শরীরে যেরকম ক্ষত হয়, শরীরে এক থেকে দুই সেন্টিমিটার দীর্ঘ সেরকম ক্ষত চিহ্ন রয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, জেলার আলোচিত এই হত্যা মামলার প্রধান আসামির (নারী) আদালতে বয়ানকে কেন্দ্র করে ক্লিন ইমেজের দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণকে অনেকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তবে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষক মহল টুনুর খুনের রহস্য উন্মোচন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কারণ একে তো নারী ওসি জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেনি, আদালতে বিচারকের সামনে যে বয়ান দিয়েছেন তাতে তদন্ত কর্মকর্তা মাইনুল ইসলামকেই অভিযুক্ত করা হয়।

সার্বিক প্রেক্ষপটে হত্যা মামলার প্রধান আসামির আদালতে এমন স্বীকারক্তি নিয়ে গোটা বরিশালে তোলপাড়। বিশেষ করে থানা পর্যায়ের শীর্ষ সারির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন নৈতিক স্থলনের অভিযোগ খোদ পুলিশের ভাবমূর্তির ক্ষুন্নের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতিগত কারণে ও উদ্ভুত পরিবেশ সামাল দিতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাসহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত ওই দুই কর্মকর্তাকে থানা প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

এমনকি ওই ঘটনার তদন্তে রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে নারীর অভিযোগ নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে। হত্যা মামলায় প্রধান আসামি থেকে রেহাই পেতে ধুরন্ধর মিনতি ওরফে মিতু নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।

যদিও নিশ্চিত কিছু এখনি বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তথ্য অনুসন্ধানে যে আলামত পাওয়া গেছে তাতে হত্যা মামলার আসামি মিনতি ওরফে মিতুর নানা নাটকীয়তার প্রমাণ মিলেছে।

উজিরপুর মডেল থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, হত্যা মামলার আসামি ওই নারীকে যৌন হয়রানি ও মারধরতো দূরের কথা, তাকে স্পর্শই করা হয়নি। নারী পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে তাকে কক্ষে ডেকে এনে পরিদর্শক (তদন্ত) মৌখিক জেরা করেন। একপর্যায়ে ওই নারীর সাথে নিহত টুনুর মোবাইলে কথোপথন এবং আপত্তিকর একাধিক ছবি প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলেই তিনি অসুস্থতার ভান করতে থাকেন। তখন ওই নারী অসুস্থ, এমনটি ভেবে পরিদর্শক (তদন্ত) তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু পুরো বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পাশাপাশি হত্যা মামলা থেকে সেইভ সাইডে যেতে একমাত্র আসামি মিনতি ওরফে মিতু এমন কৌশল নিয়েছে বলে সূত্রটির দাবি।

ঘটনার একাধিক পর্যবেক্ষকের অভিমত, একজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি নিজেকে রক্ষায় যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হত্যা মামলার আসামি মিনতি ওরফে মিতু আদালতে উপস্থিত হয়ে যে নাটকীয়তার আশ্রয় নেননি সেটাও বলা যাচ্ছে না। জেলা পুলিশ প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে যে শাস্তিগ্রহণ করেছে, সেটাও প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু ওই নারীর অভিযোগ কতটুকু সত্য তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

সেই সাথে বাসুদেব চক্রবর্তী টুনু হত্যা মামলার তদন্ত নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। এসব বিষয়ে বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম আক্তারুজ্জামান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির তদন্তকে প্রভাবমুক্ত রাখতেই অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার দাবি, নারীর অভিযোগ তদন্তে কোনো প্রকার গাফলতি ও অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেওয়া হবে না।’

আমারসংবাদ/এমএস