Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকটে স্বাস্থ্য সেবা ব্যাহত

কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি

জুলাই ১৬, ২০২১, ১০:১০ এএম


চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকটে স্বাস্থ্য সেবা ব্যাহত

স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০১৫ সালে প্রথম স্থান, ২০১৮ সালে ৫ম স্থান ও ২০১৯ দ্বিতীয় স্থান পেয়ে জাতীয় পুরস্কার পায়। 

এছাড়াও স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নের জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতি মাসে বিভাগ ও জেলার প্রথম স্থান অধিকার করে এই ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। কিন্তু বর্তমান কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় জনবল সংকট ও সরঞ্জামের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা চমর ব্যাহত হচ্ছে। এই উপজেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা জন্য চিকিৎসকের ২২টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ৮জন। বাকি পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। তবে কর্মরত ঐ ৮জন ডাক্তারের সঙ্গে ৫ জন সহকারী মেডিকেল অফিসাররা (স্যাকমো) তাদের নিজ নিজ দফতরের কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি আন্তঃবিভাগ, জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য দফতরের সাথে লিয়াজু মেনটেইনে সবসময় ব্যস্ত থাকেন। একই সাথে প্রতিদিন শতাধীক নানা রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম হচ্ছেন ঐসব কর্মরত ডাক্তার ও সহকারী মেডিকেল অফিসাররা (স্যাকমো)। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এলাকার চিকিৎসা সেবা নিতে আসা অসচ্ছল ও দরিদ্র রোগীরা। 

কালাই উপজেলা হাসপাতালে এমনিতেই সমস্যার কোন শেষ নেই। তার উপর নতুন করে এই হাসপাতালকে ‘করোনা ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করাই বাড়তি যোগ হয়েছে করোনা রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন উপজেলায় লাফিয়ে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। পরিস্থিতি মোকাবিলার যে সক্ষমতা কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকার কথা তা বর্তমান সংকট। কারণ, প্রতিষ্ঠানসমূহে জনবল ও যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রীর চরম সংকট রয়েছে। এই উপজেলায় দেড় লাখ অধিক মানুষের জন্য হাসপাতালে বেড রয়েছে মাত্র ৫০টি। ফলে এ অঞ্চলে মানুষ চরম আতঙ্ক ও শঙ্কার বিরাজ করছে। এই শঙ্কার মধ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামের মানুষের জ্বর, সর্দি-কাশি, গলায় ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হয়ে হাসপাতালে এলে তাদেরকে এন্টিজেন পরীক্ষায় ৫ থেকে ৬ ব্যক্তির শরীরে করোনা শনাক্ত হচ্ছে। বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর সংখ্যাও।

অনুসন্ধান জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫০ শয্যা বিশিষ্ট কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষণা করলেও চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকট ছিল সেই সময়েও। বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাগজ কলমে পদের সংখ্যা ৯৯ জন থাকলেও কর্মরত আছেন ৬১জন আর শূন্য পদ রয়েছে ৩৮জন। এতে জনবল সংকট থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এই উপজেলা ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ ২২ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও ডাক্তার পদায়ন না করায় বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৮জন ডাক্তার। আর বাকি পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। 

তবে কর্মরত ঐ ৮জন ডাক্তারের সঙ্গে ৫ জন সহকারী মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) আছেন। শূন্য পদগুলো হচ্ছে-জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি এন্ড অবস) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (এ্যানেসথেসিয়া) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেড্রিয়াটিক) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন) এক জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি) এক জন, হোমিও প্যাথিক/আয়োবেদিক মেডিকেল অফিসার এক জন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার এক জন ও মেডিকেল অফিসার এক জন। এছাড়াও ২য়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ২৩ পদে ফাঁকা রয়েছে। 

সেগুলো হলো-মিডওয়াইফারী একজন, এমটি ল্যাব একজন, এমটি ফিজিওথেরাপী একজন, পরিসংখ্যাবিদ একজন, প্রধান সহঃকামঃহিঃরক্ষক একজন, প্রধান সহকরী একজন, হিসাব রক্ষক একজন, স্টোর কিপার একজন, ক্যাশিয়ার একজন, অফিস সহঃকামঃ কম্পিঃঅপারেটর একজন, অফিস সহায়ক দু-জন, ওয়ার্ড বয় দু-জন, আয়া দু-জন, কুক/মশালর্চী একজন, সিকিউরিটি গার্ড দু-জন, ওটি এ্যাটেনডেন্ট/বয় একজন, মালী একজন ও সুইপার দু-জন। ঐসব পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায়। ফলে হিমশিম খাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অডিটরিয়াম (হলরুম) না থাকার কারণে সভা-সেমিনারসহ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালে আবাসিক ভবন সংকট থাকায় ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা বেশীর ভাগ বাহিরে থাকছেন। 

তাছাড়া প্রায় দেড়যুগ সময় ধরে পুরাতন অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে চলছে জরুরী রোগী আনা নেওয়ার কাজ। জেনারেটর, সৌর বিদ্যুৎ অকেজু এবং এক্স-রে মেশিন সচল হলেও পুরোনো দিনের এক্স-রে মেশিন দিয়ে চলছে এক্স-রে। ডাক্তার না থাকায় অপারেশনের যাবতীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি দীর্ঘ দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে এখানে কোন অপারেশনের কাজও হয় না।

এছাড়া ঘনবসতি ও আবাসিক এলাকায় এই উপজেলা হাসপাতালকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, জয়পুরহাট-২ আসনে এমপি ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘করোনা ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করার ফলে স্থানীয়রা করোন ভাইরাস ছড়ানোর আশংকা রয়েছে। প্রতিদিন করোন রোগী হাসপাতালে বেড়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসকদের সুরক্ষা জন্য পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট), সার্জিক্যাল মাস্ক ও হাতে গ্লাভস সংকট রয়েছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসক-নার্সরা হাসপাতালে করোনা রোগী প্রতিদিন আসা এবং থাকা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে স্বস্তি বোধ করছেন না। 
অন্যদিকে এই হাসপাতালকে ‘করোনা ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করার ফলে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা এলাকার অসচ্ছল ও দরিদ্র রোগীরা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। বর্তমান কালাই উপজেলা ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগটি প্রায় ৪শ গজ দুরে অবস্থিত কালাই এম.ইউ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে প্রতিদিন নানা ধরনের রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মরত কর্মরত ডাক্তার ও সহকারী মেডিকেল অফিসাররা (স্যাকমো)।

এলাকার সাধারণ রোগীদের অভিযোগ, কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপযুক্ত সেবা না পেয়ে সামান্য সমস্যাতেই রোগীদের জয়পুরহাট সরকারি আধুনিক হাসপাতাল অথবা বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ফলে কালাইয়ের সাধারণ রোগীরা জেলা শহরসহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও পাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্র নির্ভর হয়ে পড়েছেন। এতে করে হতদরিদ্র রোগীদের ভোগান্তির সীমা অনেক। আর এই সুযোগ বুঝে ফায়দা লুটতে ভুল করছে না- ওই সব ক্লিনিক ও প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো। অনেক সময় আবার রোগীরা এলাকার হাতুরে ডাক্তার খপ্পরেও পড়েন। তখন মড়ার উপড়ে খাড়ার ঘা। তাই সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি নিরসনে শূন্য পদে চিকিৎসক পদায়নসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন এলাকার রোগীদের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

কালাই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার তেলিহার গ্রামের পারুল বেগুম (৫৫) বলেন, কয়েক দিন যাবৎ শরীর খুব দুর্বল, কিছু খেতে পাড়ছি না। কিছু খেলেই বুমি হচ্ছে। তাই কালাই হাসপাতালে এসে ছিলাম ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু করোন রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে বলে আমি ভর্তি হতে পাড়লাম না। 

উপজেলার মাত্রাই গ্রামের আসুদা খাতুন (২৮) নামের একজন রোগী হাসপাতালে গাইনী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে এলে তাকে না পেয়ে তিনি বলেন, শুনলাম অনেক দিন ধরে হাসপাতালে গাইনী ডাক্তার নেই। তাই ফিরে যাচ্ছি। আমি গরীব মানুষ কি কররো ভেবে পাচ্ছিনা, আমাকে জরুরি ভিত্তিতে গাইনী ডাক্তার দেখাতে হবে। এখন কোন উপায় না, তাই যেকোন ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।

উপজেলার রাগোতপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম (৩৭) অভিযোগ করে বলেন, ধানের কাজ করার সময় আমার কোমড়ে ব্যাথা পেয়ে ছিলাম। সেই ব্যাথা এখন আরও বেশি হচ্ছে। তাই এই হাসপাতালে আসলাম। বহির্বিভাগে কর্তব্যরত এক ডাক্তার বললেন এখানে হবেনা জয়পুরহাট সরকারি আধুনিক হাসপাতালে যেতে বললেন। আমি কি ভাবে যাবো তা ভেবে পাচ্ছি না।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন মেডিকেল অফিসার জানান, বর্তমানে জরুরি বিভাগ, আন্তঃবিভাগ, বর্হিবিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগ যথারীতি চালু আছে। তবে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন অডিটরিয়াম নেই। আবাসিক ভবন সংকট থাকার কারণে ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা বেশীর ভাগ বাহিরে থাকছেন। বর্তমান অ্যাম্বুলেন্সটি প্রায় দেড়যুগের। সেই অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে কষ্ট করে জরুরী রোগী আনা নেওয়ার কাজ চলছে। 

তাছাড়া জেনারেটর, সৌর বিদ্যুৎ অকেজু এবং এক্স-রে মেশিন সচল হলেও পুরোনো দিনের এক্স-রে মেশিনটি। আবার ডাক্তার না থাকায় অপারেশনের যাবতীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি দীর্ঘ দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। এই হাসপাতালকে স্থানীয় ভাবে ‘করোনা ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করার ফলে চিকিৎসকদের সুরক্ষা জন্য পিপিই, সার্জিক্যাল মাস্ক ও হাতে গ্লাভস কিছুটা সংকট রয়েছে। এর মাঝেও আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসক-নার্সরা হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।

কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.নূর আসাদ উজ-জামান বলেন, এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসারের পদ কম থাকলেও সামার্থ্য অনুযায়ী রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাছাড়া এই হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষণা করার ফলে এলাকার করোনা রোগীদের স্থাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। 

আমারসংবাদ/কেএস