Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

দুই পায়ে আর দুই চাকার দোকানে চলে ওদের জীবন

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১, ০৬:০০ এএম


দুই পায়ে আর দুই চাকার দোকানে চলে ওদের জীবন

চল্লিশ বছর বয়সের রাশেদ আহম্মেদ। ঘরে স্ত্রী, দুই সন্তান ও মা নিয়ে মোট ৫ জনের সংসার। আয় রোজগার করার একমাত্র পথ দুই চাকার বাইসাইকেল, তার উপর দোকান। সকাল হলে সাইকেলের উপর দোকান নিয়ে ছুটে চলে এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামে। দোকানে রয়েছে বিশ টাকা হতে একশত টাকার বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র। 

প্লাস্টিকের ছোট মগ, খাবার ঢাকনা, মশলাদানি, শিশুদের খেলনা, বাঁশি, বালতি, কলমদানি, ছোট গামলা, সাবান কেচ, ডিব্বা, ফলঝুড়ি, দুদ ছেকনি, টিফিন বক্স, চালুনি, সুজি ছাকনি ইত্যাদি। এসব জিনিসপত্র নিয়ে কাক ডাকা ভোরে হতে শুরু হয় রাশেদের ছুঁটে চলা। দিনে ৫শ হতে ৭শত টাকা আয় করতে হবেই,তা-না হলে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়বে। 

[media type="image" fid="143848" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

চলার পথে মধুখালীতে হঠাৎ দেখা হওয়া রাশেদ বলেন, কি আর করব। অন্য ভারী কাজ করতে পারি না। সাইকেলে করে প্লাস্টিকের তৈরী জিনিসপত্র বিক্রি করি। দিনে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে ৫ জনের সংসার। আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। রাশেদের মতো ফরিদপুরে আরও বেশকিছু লোক আছে এ রকম ফেরি করে চলে তাঁদের সংসার। মধুখালী উপজেলার মেকচামী এলাকায় কথা হয় করিম নামের এক ফেরিওয়ারার সাথে। 

তিনি বলেন, সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে গজ কাপড়, বালিশের কভার, বিছানা চাঁদর বিক্রি করি। সংসার চলে যায়।

এদিকে আবারও দলে দলে নেমেছে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামের মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের অতিপ্রিয় লেইসফিতাওয়ালা-ফেরিওয়ালারা। শহরের অলিগলিসহ পল্লীগ্রামে ফের শোনা যাচ্ছে সেই সুরেলা ডাক-লেইস ফিতা লেইস।

এই লেইস ফিতা ওয়ালারা কয়েকযুগ আগে গ্রাম-গঞ্জে তরুণী, বালিকা-কিশোরিদর কাছে ছিল বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আধুনিক যুগে যেন এপেশায় অনেকটা ভাটা পড়ে। পল্লীগ্রাম থেকেও যেন তারা হাড়িয়ে যায়। আবার যেন ফিরে এসেছে সেই হারিয়ে যাওয়া চুড়ি, ফিতা সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করা ফেরিওয়ালারা।

বিশেষ করে গ্রামে আজও খুবই জনপ্রিয় সাধারণ চাকরিজীবী, তরুণী, বালিকা-কিশোরিদের কাছেও। কারণ তাদের কাছে অতি অল্প দামে মেলে ক্রিম-পাউডার, চুলের ফিতা, ক্লিপ, চুলবাঁধার কাঁটা, রাবার ব্যান্ড, সেফটিপিন, চুড়ি, পুঁতিরমালা, ইমিটেশনের গয়না, জেড পাথর ও আর্টিফিশিয়াল মুক্তার মালা। 

চাই কী সাজগোজ করার উপটান, আই লাইনার, খোঁপার কাঁটা, শীতের ভ্যাসেলিন, চুলের সুগন্ধী তেল, নানা ব্র্যান্ডের দেশি-বিদেশি গোসল করার সুগন্ধী গ্লিসারিন সাবান, নারীদের পরিধেয় কাপড় অলংকৃত করতে জরির লেইসসহ আরো কতো কি।

ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগুলোতে এসব লেইস ফিতা ওয়ালারা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ান মালামালের বিশাল বোঝা, হাতে কাচ বাঁধানো একটি ভ্রাম্যমাণ শো-কেস নিয়ে সেই আগেকার মতো গ্রামের পাড়ায়-মহল্লায়, বাড়ির আঙিনায় এসে হাঁক দিচ্ছে- ‘লেইস ফিতা লেইস’ ‘এই লেইস ফিতা-চুড়ি-খাড়ু হরেক রকম জিনিসপত্র'। গ্রামের সাধারণ নারী, গৃহবধূরা এসে ভিড় করেন ঘরের দুয়ারে, লেইস ফিতা ওয়ালার কাছ থেকে দরদাম করে কিনে নেন যার যার প্রয়োজনীয় সামগ্রী। 

বধু-কন্যা-মাতাদের জটলায় ঘরের দুয়ারে যেন কেনাকাটার উৎসব শুরু হয়ে যায়। একসময় সচরাচর এ দৃশ্য চোখে দেখা গেলেও মাঝে অনেক বছর এর দেখা মিলত না। নতুন করে এই দৃশ্যটি ফরিদপুরের নয়টি উপজেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষের বসতবাড়ির দুয়ারে-আঙিনায় যেন আগের মতোই দৃশ্যমান। তবে আগের তুলনায় এর সংখ্যা কম।

সালথা উপজেলার গ্রামে গ্রামে হেঁটে লেইস ফিতা, লেইস ফিতা-চুড়ি-খাড়ু, রঙিন সুতা বলে হাঁক দিচ্ছিলেন এমনই একজন, নাম তার আকিদুল। বাড়ি পাশের উপজেলা নগরকান্দা। আকিদুল জানান, সালথা,নগরকান্দা,সদরপুর এলাকার প্রায় ২০/৩০ জন এ পেশায় রয়েছেন। এরমধ্যে কেউ নতুন আবার কেউ অনেক পুরনো। এটাই তাদের জীবিকা। 

পায়ে হেঁটে চলা ময়েনদিয়া এলাকার ফেরিওয়ালা উচমান সেখ বলেন, বাড়িতে তার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। সন্তানরা লেখাপড়া করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০/৬০০ টাকা, আবার কোনো কোনো দিন ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে। পায়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন তার মতো আরো অনেকেই আছেন বলে জানান তিনি।

সালথা, বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, মধুখালী এলাকার গৃহবধূ মনিতারা, সাদিয়া বেগম, রুপালি জাহান, শিখা মন্ডল, করুনা বিশ্বাস, স্নেহ বিশ্বাস, মালতি রানী, লাকি দাসসহ অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হলে তারা জানান, এসব ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে নেপথালিন, সেফটিপিন. সুঁইসুতা, এমব্রয়ডারি করার উপকরণ, মাথায় মাখার সুগন্ধী তেল, চুলের ক্লিপ, সাবানসহ প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি বিভিন্ন ধরনের অনেক পণ্য ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেই কিনে থাকেন। 

এদের কাছ থেকে কেনা এসব পণ্য গুণেমানেও ভালো পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।তাছাড়া বাড়ির কাজকর্ম রেখে বাজারের দোকান-পাটে এসব কিনতে যাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না।আবার অনেকের বাড়ির কর্তারা এসব জিনিস পত্র আনতে বললেও কিনে আনে না। তাই বাড়ি-ঘরে বসে এসব জিনিসপত্র ক্রয় করা তাদের জন্য অনেক সুবিধাজনক বলেও তারা জানান।

এ বিষয়ে বোয়ালমারী উপজেলার বাসিন্দা,সাংস্কৃতিক কর্মী সুমন খান জানান, ছোটকালে দেখছি মা-চাচি-খালা,ফুফুদের এসব ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে তাদের বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এসব ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে ক্রয় করতে। মাঝে এদের একেবারেই দেখা যেত না। এখন চলার পথে অল্প কিছুদের চোখে পড়ে।

[media type="image" fid="143849" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

শেখর এলাকার মহিলা মেম্বার ও মহিলা নেত্রী নাজমা বেগম, জানান আগেরকার দিনে প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসব ফেরিওয়ালারা গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আসতো। মাঝে একেবারেই দেখা যেতো না। এখন আবার দেখা যাচ্ছে। তবে পাড়া-গ্রামের গৃহবধুরা নিজের ও সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এসব ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে ক্রয় করে থাকেন এবং তাদের অনেক সহজলভ্য হয়।

বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শরীফ সেলিমুজ্জামান জানান, একসময় হারিয়ে গেলেও এখন গ্রামগুলো এসব ফেরিওয়ালাদের দেখা মেলে। তিনি এসব অল্প পুঁজির ফেরিওয়ালাদের টিকিয়ে রাখতে সরকারি- বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণসহ সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন।

মধুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো.শহিদুল ইসলাম জানান, মধুখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের এরকম ফেরিওয়ালাদের খোঁজ নিয়ে ক্ষুদ্র লোনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।