Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রেমের টানে বাংলাদেশে আসা ফিলিপাইনি নারী এখন ইউপি সদস্য

ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি

নভেম্বর ১৩, ২০২১, ০৬:৫০ এএম


প্রেমের টানে বাংলাদেশে আসা ফিলিপাইনি নারী এখন ইউপি সদস্য

ভালোবাসার টানে নিজ দেশ-ধর্ম ছেড়ে ১০ বছর আগে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ময়মনসিংহের মো. জুলহাস উদ্দিনকে। এবার ফুলবাড়িয়ার ১১নং রাধাকানাই ইউনিয়ন থেকে ইউপি নির্বাচনে ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য পদে নির্বাচিত হলেন জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা ওরফে জেসমিন আক্তার।

দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন রাধাকাইন ইউনিয়নের কোদালি পাড় গ্রামের জুলহাসের স্ত্রী ফিলিপাইনের মেয়ে (বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিক) জেসমিন। সংরক্ষিত ওয়ার্ডে তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাতে মাইক প্রতীক নিয়ে ৪ হাজার ৪৯৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ১ হাজার ৮৩৭ ভোট।

জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমান ফুলবাড়িয়ার রাধাকানাই ইউনিয়নের দবরদস্তা গ্রামের আবদুস সামাদ মণ্ডলের ছেলে জুলহাস মিয়া। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর একই কোম্পানিতে চাকরিরত ফিলিপাইনের নাগরিক জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকার সঙ্গে পরিচয় হয়। দীর্ঘদিনের প্রবাসজীবনে তাদের মধ্যে সেই পরিচয় ভালোবাসায় গড়ায়। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা তার নিজ দেশ ফিলিপাইনে চলে যান। অন্যদিকে, জুলহাস মিয়াও বাংলাদেশে চলে আসেন। কিন্তু তারা প্রেমের সম্পর্ক ঠিক রাখাতে মুঠোফোনে নিয়মিত যোগাযোগ চালিয়ে যান। 

পরে জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকাকে বিয়ে করতে ফিলিপাইনে যান জুলহাস। জিনের পারিবারিক সম্মতিক্রমে বিয়ের সব আয়োজন ঠিক করেন তিনি। বিয়ের পূর্বমুহূর্তে সংশ্লিষ্ট বিয়ের আয়োজকেরা বলেন, দুজন দুই ধর্মের, সংসারজীবনে অশান্তি তৈরি হতে পারে। তাই দুজনের যেকোনো একজনকে তার ধর্ম ছেড়ে আসতে হবে। সেই মুহূর্তে সাহসী ভূমিকা রেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা। তার নতুন নাম রাখা হয় জেসমিন আক্তার জুলহাস। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এ দেশের নাগরিকত্ব পান তিনি। 

২০১০ সালের দিকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। বিয়ের পর থেকে ধর্মীয় সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে দিন যাপন করছেন জেসমিন। বাংলাদেশে প্রায় ১১ বছর হয়ে গেছে তার সংসারের বয়স। জাহিদুল ইসলাম ও ফারিয়া আক্তার নামের দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে এ দম্পতির।

জুলহাস মিয়া বলেন, সিঙ্গাপুরে একই কোম্পানিতে চাকরি করতাম দুজন। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, সে আমার জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে সোজা বাংলাদেশের চলে আসে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কিছুদিন থাকার পর সে হয়তো আর আমার সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। যতই মানুষটাকে দেখি, অবাক হতে থাকি। খুব অল্প দিনের মধ্যে এ দেশের মানুষ, মা-বাবাসহ সবাইকে আপন করে নেয়, সবার মন জয় করে নেয়। শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসা অনেক। জনমতের কারণে এলাকাবাসীর অনুরোধেই রাধাকানাই ইউনিয়নের ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য উদ্যোগ নিই। নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর সবার কাছ থেকে বেশ সাড়া পাচ্ছিলাম। সবাই চাচ্ছে সে প্রতিনিধি হয়ে আসুক। ঠিক নির্বাচনের দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ আমার স্ত্রীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। আমার পক্ষ থেকে ভোটারদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

জীন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা বলেন, ১০ বছর হয়ে গেছে আমি এখানে এসেছি। বাবা-মা ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়েছে। শুরুতে বেশ বিপাকে ছিলাম। কারণ আমি বাংলা বলতে পারতাম না। আর এখানকার মানুষ ইংরেজি বুঝে না। তবে আস্তে আস্তে শিখার চেষ্টা করেছি। এখন আমি সবার কথাই মোটামুটি বুঝি। আমিও কিছু কিছু বলতে পারি।

নির্বাচন করার কোনো পরিকল্পনা কখনো ছিল না জানিয়ে এ নারী বলেন, আমি নির্বাচনে দাঁড়াতে চাইনি, ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু এলাকার মানুষ জোর করে বলেছে নির্বাচন করতে। তারা আমাকে খুব ভালোবাসে, তাই তাদের কথা রাখতেই আমি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। প্রার্থী হওয়ার পর অনেক কষ্ট করেছি। সকালে নাস্তা খেয়ে প্রচারণায় বের হয়ে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসেছি। কিন্তু জয় পাওয়ার সব কষ্ট ঘুচে গেছে।

তিনি বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই সরকারকে। কোনোরূপ জটিলতা ছাড়াই এ দেশের সরকার আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়েছে। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তবে নারীদের ভেতর শিক্ষার অভাব রয়েছে। অনেক শিশু স্কুলে যায় না। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে কৃষকেরা তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই সমস্যাগুলো সমাধানে আমি সব সময় ভাবতাম কী করা যায়। ভোট দিয়ে যেসব মানুষ আমাকে জয়যুক্ত করেছে, আমি যেন সারা জীবন তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারি।

এদিকে রাধাকানাই ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনে এলাকার পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ায় খুশি সবাই। বাড়িতে এসে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি করেছেন আনন্দ মিছিলও। সুফিয়া খাতুন নামে এক প্রতিবেশী বলেন, তিনি নিজের দেশ, পরিবার ছেড়ে এখানে এসে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছেন। আমরাও তাকে অনেক পছন্দ করি। সেজন্যই তাকে আমরা ভোট দিয়ে পাস করিয়েছি। তিনি এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন।

আমারসংবাদ/জেআই