Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

নামে ২০ কাজে ৮!

আবদুর রহিম

আবদুর রহিম

মে ২৩, ২০২২, ০১:৩৪ এএম


নামে ২০ কাজে ৮!

নেতা আছে তো কর্মী নেই। এ অবস্থা ২০ দলীয় জোটের ১০টি শরিক দলের। বাসার ঠিকানায় দলীয় কার্যালয়। অনেক দলের দলীয় কার্যালয়ের নেই অস্তিত্ব। শুধু ব্যক্তিনির্ভর হয়ে চলছে তিনটি দল। বিএনপি, জামায়াত ছাড়া সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই ১৪-১৫ দলের। বিগত প্রায় পাঁচ বছর নেই জোটের কর্মসূচিও। আবার জোটে থেকেও ছায়ার মতো আড়ালে জামায়াত, এলডিপি ও কল্যাণ পার্টি। দুই বছরেরও বেশি সময় হয়নি জোটের আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক। জোটের নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধু নামে আছে ২০ দলীয় জোট। এর মধ্যে অন্তত ১০টি দল রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না।

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, জোট গঠনে বিএনপি সফল হলেও এর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। অদৃশ্য কারণে ভোট এলে ছোট দলগুলোর কদর বাড়ে। বাস্তবে ভোট ব্যাংকেও কোনো প্রভাবই নেই বেশ কিছু শরিক দলের। সারা বছর এদের দেখা যায় না। সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা জোটের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেও এদের উপস্থিতি শূন্যের কোটায়। অনেকে আবার বছরের পর বছর দেশের বাইরে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন, দলের কোনো খবরও রাখছেন না। জোটের নেতৃত্বদানকারীদের দুর্বল ভূমিকা নিয়ে শরিকদের বড় একটি অংশ মুখও ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে জোটে সক্রিয় শরিকরা বলছে, ভোটের আগেই জোটের গুরুত্ব বাড়বে, কর্মসূচি আসবে।

তিন ধাপে বাড়ে ২০ দলের সংসার : বিএনপির ২০ দলীয় সংসার তিন ধাপে বাড়ে। প্রথমত, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সাথে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

দ্বিতীয়ত,  দীর্ঘ ১২ বছর পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে জোটে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। কিছু সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকে জোটের কদরও।

বাসার ঠিকানায় দলীয় কার্যালয়, নেই অনেকের অস্তিত্ব :  বর্তমানে ২০ দলীয় জোটের বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে মাত্র চারটি দলের। নিবন্ধন থাকা সাতটি দলের মধ্যে নির্বাচনের আগে-পরে তিনটি দল জোট ত্যাগ করে। বাকি দলগুলোর  অনেকেরই নেই রাজনৈতিক অস্তিত্ব। বাসার ঠিকানায় দেয়া দলীয় কার্যালয়ের ঠিকানা। ভাড়া দিতে না পারায় অনেকের কার্যালয় দখল হয়ে গেছে। জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আহমেদ দীর্ঘদিন প্রবাসেই কাটাচ্ছেন। এ দলটির নেই কোনো নেতাকর্মীও। এ ছাড়া সভাপতি ছাড়া চলছে মুসলিম লীগ। শুধু জোটের খাতা-কলমেই দলটি রয়েছে। কোনো কর্মসূচিতেও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজস্ব কোনো কার্যালয়ও নেই। প্রয়াত সভাপতির বাসার ঠিকানা ব্যবহার করে চলছে দলীয় কার্যক্রম।

ব্যক্তিনির্ভর তিনটি দল, নেই দলীয় কার্যালয় : ২০ দলীয় জোটের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপি ও বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি মূলত এক ব্যক্তিনির্ভর দল। তাদের কার্যক্রম মূলত ২০ দলীয় জোটের কোনো বৈঠকে চেয়ারম্যানদের অংশ নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জোটের বৈঠকে ফটোসেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাঠপর্যায়ে এ তিনটি দলের কোনো নেতাকর্মীও নেই। দলীয় কিংবা জোটের কর্মসূচিতেও এদের অবস্থান দেখা যায় না। এর মধ্যে দলীয় কার্যালয় নেই ইসলামী ঐক্যজোটের। জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান আব্দুর রকিব বলেন, একসময় আমাদের নিজস্ব কার্যালয় ছিল। সেটি দখল হয়ে যায়। আমাদের দলীয় কর্মসূচি চলে ভাইস চেয়ারম্যানের বাসায়। আমরা আগামী নির্বাচনের আগেই কার্যালয় নেবো। সেই প্রস্তুতি চলছে।

জোটে থেকেও আড়ালে জামায়াত, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি : জোটের সক্রিয়দের নিয়েও বর্তমানে ভালো নেই ২০ দলীয় জোটের সংসার। ডা. কামাল হোসেনকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার পর বিএনপি জোটে ২০ দলীয় জোটের দূরত্ব স্পষ্ট হয়েছে। বাড়ে অভিমান। ২০ দল থেকে পাঁচটি দল জোট ছেড়ে চলে গেছে। ভেঙে গেছে জোটের আরো সাতটি শরিক দল। তবে সব দলেরই ক্ষুদ্র অংশ রয়ে যাওয়ায় খাতা-কলমে এখনো ২০ দল দাবি করা যাচ্ছে। 

জোটের তিন শরিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি ও কল্যাণ পার্টি অনেকদিন ধরেই জোটের অংশগ্রহণ থেকে দূরে রয়েছে। এই তিন দল নিয়ে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন রয়েছে বিএনপির ভেতরে-বাইরে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াতের সাথে দূরত্ব বজায়ে রেখেছে বিএনপি। জামায়াতও চলছে একলা চলো নীতিতে।  

এরই মধ্যে জামায়াত, অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির মধ্যে ভালো সখ্য তৈরি করেছে। অলি আহমেদ বেশ কয়েকটি সভা-সেমিনারে জামায়াতের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। অলি আহমেদ পাশের একটি দেশের সাথে সুসম্পর্কের বিষয়টিও রাজমাঠে আলোচনায় রয়েছে। বাংলাদেশে একমাত্র রাজনীতিবিদ অলি আহমেদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় জানিয়ে থাকেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখে জোটের অন্য শরিকরা।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই দলগুলো ভোট এলে গুরুত্ব বাড়ে। কিন্তু সারা বছর এদের দেখা যায় না। সরকারবিরোধী আন্দোলনে কিংবা জোটের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেও এদের মাঠে পাওয়া যায় না। তারা বলছে, জোট গঠনে বিএনপি সফল হলেও এর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। নতুন জোট ঐক্যফ্রন্টের নামেই বিএনপি ও ২০ দল ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০ দলকে ৪০টি আসন এবং ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসনে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। কিন্তু পুরো জোটে বিএনপি পায় ছয়টি আসন এবং গণফোরাম পায় দুটি আসন।

ভোট এলে জোট ভাঙে : ভোট এলে যেমন জোটের গুরুত্ব বাড়ে তেমনি ভাঙনও তৈরি হয়। জানা যায়, ২০১৪ সালে বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিএনপির সংসার ত্যাগ করেন শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি। তাদের অভিযোগ ছিল— বিএনপি প্রধান শরিক জোটের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। বিএনপি ভোটের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত একার, জোটের নয়। তবে দলটির মহাসচিব ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে একটি অংশ বিএনপির সংসার ত্যাগ করেনি। 

২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি একই অভিযোগ তুলে বিএনপির সাথে প্রায় দুই যুগের সম্পর্ক ছিন্ন করে জোট ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট। তখনো এ দলটির  ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিবের নেতৃত্বে একটি অংশ জোটে থেকে যায়। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন নিয়ে ওই বছরের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি জোট থেকে বেরিয়ে যায়। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৮ সাল) জোট ছাড়ে লেবার পার্টির মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদীর নেতৃত্বে দলটির ছোট একটি অংশও। আবার একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৬ মে জোট ত্যাগ করেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। ওই বছরই  ১৪ জুলাই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। সর্বশেষ ১ অক্টোবর জোট ত্যাগ করে খেলাফত মজলিস।  ছয়টি দল ও একটি দলের ছোট একটি অংশ জোট ছাড়ে। নামে ২০ দল হলেও কার্যকরভাবে রয়েছে মাত্র কয়েকটি দল।

যাদের নিয়ে ২০ দল : ২০ দলীয় জোটের দলগুলো হলো—  বিএনপি, জামায়াত, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, কল্যাণ পার্টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাপ-ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক লিগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পিপলস লিগ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও খেলাফত মজলিস। 

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান আমার সংবাদকে বলেন, ‘২০ দলীয় জোটের সর্বশেষ কবে বৈঠক হয়েছে আমার ঠিক জানা নেই। মনেও পড়ছে না। একাদশ সংবসদ নির্বাচনের পর কয়েকটা বৈঠক হয়েছে। তবে আমাদের দলীয় কর্মসূচি চলছে। আমাদের ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের সালে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। জোটের কার্যক্রম কিছুটা ঢিলেঢালা চলছে এটি ঠিক,  নির্বাচনকে সামনে রেখে খুব শিগগিরই জোটের পক্ষ থেকেও কর্মসূচি আসবে বলেও ইঙ্গিত র?য়েছে। আমরা লেবার পার্টি সারা বছর জন ইস্যু নিয়ে কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছি। গত সপ্তাহেও আমরা জাতীয়ে সরকার ইস্যুতে সেমিনার করেছি, সেখানে দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমার দলের প্রধান আক্রোশের শিকার। তিনি গৃহবন্দি। আমাদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান দেশের বাইরে এরকম একটা পরিস্থিতিতেও দল ঐক্যবদ্ধ। এক যুগের বেশি সময় বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকলেও কোনো ভাঙন সৃষ্টি হয়নি। আমাদের দল থেকে কেউ চলে যায়নি। অনেক ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আমরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। জোট নিয়ে আমাদের দীর্ঘ সময় ঘোষিত বৈঠক হয়নি ঠিকই কিন্তু সবার সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। জোটকে অ্যাকটিভ করার জন্য আমরা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করছি। আমরা সবাইকে নিয়ে আরও বৃহত্তর জোট গড়ার জন্য কাজ করছি।’ 

Link copied!