Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

ফৌজদারি অপরাধেও জেলে যেতে হবে না!

আমিরুল ইসলাম

আমিরুল ইসলাম

মে ২৪, ২০২২, ০১:৫৪ এএম


ফৌজদারি অপরাধেও জেলে যেতে হবে না!

অপরাধীর প্রচলিত অর্থে শাস্তি হবে না। থাকতে হবে না কারাগারে! অর্থাৎ জেল কিংবা জরিমানাও হবে না। তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। থাকবে কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণও।

দেয়া হবে ঋণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, হাঁস-মুরগি পালন, গরুর খামার স্থাপন ও পরিচালনের জ্ঞান। ব্যবসা শুরুর আগের প্রস্তুতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও ঋণ দিয়ে সহায়তা করা হবে অপরাধীদের। জেলে রাখার পরিবর্তে অবৈতনিক কমিউনিটি সার্ভিসে তাদের নিয়োগ দেয়া হবে। 

পুরুষ, নারী, প্রবীণ ব্যক্তি ও হিজড়াদের তথা তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের এই আইনের আওতায় সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। উল্লিখিত সব বিধান রেখে ‘দ্য প্রবশেন অব ওপেন্ডারস অর্ডিনেন্স-১৯৬০’ আইনে রূপান্তর করছে সরকার। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং শিগগিরই তা চূড়ান্ত করা হবে। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ প্রতিরোধে শাস্তি সহায়ক না হয়ে অপরাধ বিস্তারে সহায়ক হয়।  অপরাধের দায়ে কোনো অপরাধীকে যখন কোনো কারাগারে পাঠানো হয়, কারাগারে থাকাকালীন সময়ে সে অন্যান্য দাগী অপরাধীর সংস্পর্শে এসে ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধের অভিজ্ঞতা ও ক্ষতিকর কুশিক্ষা  লাভ করে থাকে। 

অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা অপরাধ সংশোধনের ক্ষেত্রে একজন অপরাধীর শাস্তিদান ব্যবস্থার পরিবর্তে সংশোধনমূলক সংশোধন অর্থাৎ শাস্তির পরিবর্তে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে তার নিজ পরিবেশে অর্থাৎ সমাজে রেখেই সংশোধন ও পুনবার্সনমূলক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এই আইনে ফৌজদারি অপরাধের দোষী কোনো অপরাধীর বিচার করা হবে না। অর্থাৎ খুন, হত্যা, ডাকাতি, মাদক কারবারি, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের কোনো বিচার হবে না। ছোটখাটো চুরি, প্রতারণা, লঘু প্রকৃতির আঘাত, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোসহ ছোটখাটো প্রতারণার বিচার করা হবে। এসব অপরাধের দায়ে কাউকে দাগী আসামি করে ফেলার কোনো মানে হয় না। 

সব ছোট অপরাধীকে বড় বড় অপরাধীর সাথে গুলিয়ে ফেললে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। তাই আইনটি করা হচ্ছে। অবশ্য এ ধরনের কার্যক্রম আগে থেকেই করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণলায় ও অধিদপ্তর। তাছাড়া অর্ডিনেন্সটি আইনে রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 

আইন প্রণয়নের বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুলতানা সাঈদা আমার সংবাদকে বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই আইন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আইনটি নিয়ে কাজ চলছে। বিস্তারিত বলার মতো এখনো সময় হয়নি। তিনি যুগ্ম সচিব গিয়াস উদ্দিন মোগলের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। 

গিয়াস উদ্দিন মোগল বলেন, আইনটি সমাজসেবা অধিদপ্তর করছে। তারা বিস্তারিত বলতে পারবে। তিনি উপ-পরিচালক লামিয়া ইয়ামিনের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। 

উপ-পরিচালক লামিয়া ইয়ামিন বলেন, নতুন আইনে কমিউনিটি সার্ভিসে কী কী কাজ করানো হবে তা অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি বলতে পারবে। এক কথায়, তারা কেউ দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে চাননি। কারাগার অভ্যন্তরে কয়েদিদের জন্য বয়স্ক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা, খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা, কয়েদিদের জন্য কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া, কাউন্সেলিং ও মোটিভেশনাল বৈঠকের আয়োজন করা, মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা, প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন প্রকার কাজে নিয়োজিত করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, কয়েদিদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সমাজে প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা। 

প্রয়োজনবোধে কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে এককালীন আর্থিক ঋণ দিয়ে তাদের স্থায়ী আয়ের রোজগারে সহায়তা করা। এছাড়া কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা, অপরাধীদের কল্যাণ সাধনের জন্য বিভিন্ন বিভাগ বা অফিসের মধ্যে সংযোগ সাধন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন যেসব অপরাধী আদালতে জামিন লাভ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনবোধে তাদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করা। 

কারাগার অভ্যন্তরে বয়স্ক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে অপরাধের কুফল সম্পর্কে সচেতন ও অপরাধবিমুখ করা, খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন করা, কাউন্সেলিং ও মোটিভেশনের মাধ্যমে অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল ও উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলা, এককালীন আর্থিক ঋণ কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করা হবে। 

আইনে বলা হয়েছে, কোনো শিশুর অপরাধ দেখে যদি মনে হয় সে ইচ্ছে করে অপরাধটি করেনি বরং সে পরিস্থিতির শিকার, সে ক্ষেত্রে তাকে সতর্ক করে কিংবা তিরস্কার করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে। আগামী এক বছর কোনো ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হবে না এমন অঙ্গীকার করলেও জামিনদার ছাড়া অথবা জামিনদারসহ মুচলেকা রেখে অব্যাহতি দেয়া যাবে। 

এ ক্ষেত্রে প্রবেশন অফিসার অথবা আদালত সময় নির্ধারণ করে দেবেন। আদালত শিশুটির কাছে অপরাধের সহজবোধ্য ব্যাখ্য দেবেন। অব্যাহতির সময়ে যদি সে নতুন করে কোনো অপরাধ করে তাহলে আগের অপরাধের জন্য আদালত আটকাদেশ দেবে। 

নতুন অপরাধের বিচার চলবে। কোনো পুরুষ ব্যক্তি ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে বর্ণিত অপরাধসমূহ এবং মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অন্যান্য বিশেষ আইনে সাত বছরের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী না হলে এমন ব্যক্তি, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে বিচারের সময় অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধীর চরিত্র, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, অপরাধ সংগঠনে তার সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় নেবেন। 

শাস্তির ক্ষেত্রে অপরাধী পুরুষ অথবা নারী হলে কমপক্ষে এক বছর সর্বোচ্চ তিন বছর সংশোধনাগারে (প্রবেশনার উন্নয়ন কেন্দ্র) থাকার আদেশ দেবেন। প্রতিবন্ধী, প্রবীণ ব্যক্তি এবং হিজড়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয়মাস সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য প্রবেশনার উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকার আদেশ দেবেন। তবে যেসব অপরাধীর আদালতের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় থাকার এবং কর্ম করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা রয়েছে তাদের কাছ থেকে অপরাধ না করার মুচলেকা নিয়ে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করবেন। যাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই কেবল তাদের প্রবেশনার উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে।

শিশুদের সংশোধনাগারে পাঠানোর আগে তার বয়স, স্বভাব চরিত্র, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, অপরাধের প্রকৃতি, অপরা সংগঠনের কারণ, পটভূমি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিশুর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা, শিশুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্ব্বিক পটভূমি এবং শিশুর মতামত যাচাই করবেন। অপরাধ থেকে মুক্তি দেয়ার  সময় শিশুর আইনগত অভিভাবকদের কাছ থেকে মুচলেকা রাখা হবে। 

ছোট অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ আদেশ দিয়ে কমিউনিটি সার্ভিসে নিযুক্ত করতে পারবেন। সর্বোচ্চ দুই বছর এবং সর্বোনিম্ন ছয় মাসের আদেশ দিতে পারবেন। সরকার পরিবার বিচ্ছিন্ন বা পরিবারহীন ও নিরাশ্রয় অপরাধীদের আবাসন, সংশোধন, উন্নয়ন, পুনর্বাসনের জন্য লিঙ্গভেদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। 

সরকার যেকোনো সময় যেকোনো প্রতিষ্ঠান অপরাধীর আবাসন, সংশোধন উন্নয়ন ও পুনর্বাসন ঘোষণা করতে পারবে। সরকার নির্ধারিত শর্তপূরণ সাপেক্ষে পূর্বানুমতি নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে অপরাধী সংশোধনাগার স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে। বৈধ প্রত্যয়ন ছাড়া কেউ অপরাধী সংশোধনাগার স্থাপন কিংবা পরিচালনা করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে অপরাধী ব্যক্তি ও দোষী সাব্যস্ত শিশুর সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি গঠন করবে।

Link copied!