Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪,

মামলা করেও হারছে রাষ্ট্রপক্ষ

শরিফ রুবেল

জুলাই ২৫, ২০২২, ১২:৩৭ এএম


মামলা করেও হারছে রাষ্ট্রপক্ষ

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই সরকারের ৪০ শতক খাসজমি দখলে নেয় রাশেদুল ইসলাম। চাঁদপুরের কচুয়ার তুলপাই ফতেপুর মৌজায় তুলপাই বাজারের ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা করে সরকার। তবে ব্যর্থ হয়ে এ নিয়ে ১৯৬১ সালের ২৭ মার্চ একটি মামলা হয়। 

বিচার শেষে আদালত ১৯৬৯ সালের ১৪ অক্টোবর রাশেদুলের পক্ষে রায় দেন। নিয়ম অনুযায়ী রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। পরে পাকিস্তান সরকার আর আপিল করেনি। 

তারপর সেই দায়িত্ব চাপে বাংলাদেশ সরকারের কাঁধে। সরকারপক্ষ আপিল করে ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ততদিনে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৪০ বছর। শুনানিতে উচ্চ আদালত সেই আপিল তামাদি বলে খারিজ করে দেন। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ওই ব্যক্তির নামেই জমিটির নামজারি করে দেয়।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার নুরুল্লাগঞ্জ শেওজা এলাকায় সরকারের দশমিক ৬০ একর জমি নিয়ে মোশাররফ হোসেন গং ফরিদপুরের সহকারী জজ আদালতে মামলা করে। আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেন। তার সাড়ে ২২ বছর পর করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডে চিঠি পাঠায় জেলা প্রশাসন। 

তারও অনেক দিন পর ভূমি মন্ত্রণালয়কে তা জানায় ভূমি সংস্কার বোর্ড। ততদিনে মামলাটি তামাদি হয়ে যায়। ফলে উচ্চ আদালতে আপিল করে সরকারের পক্ষে ওই জমি ফেরত পাওয়ার পথ বন্ধ হয়। 

১৯৪৫ সালে জমির মালিক বীরেন্দ্রনাথ রায় তার সাড়ে ১৯ কাঠা জমির আম মোক্তার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দিয়ে যান স্থানীয় সিরাজুল হককে। ২০ বছর পর ১৯৬৫-৬৬ সালে ওই জমির খাজনা দিয়ে নিজের নামে নামজারি (মিউটেশন) করান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। 

কিন্তু পরবর্তীতে খাজনা না দেয়ায় ১৯৯৯ সালে সরকার এ জমির খাজনা দাবি করে মামলা করে। এ মামলার পর ওই বছরের ২৫ জুলাই সিরাজুল হক দুই হাজার ৭৯২ টাকা খাজনা পরিশোধ করে জমির ভোগদখল করতে থাকেন। 

২০০৮ সালে মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। এরপর এ জমির খতিয়ান সংশোধন চেয়ে মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ। পরে ২০০৯ সালের ২৩ জুন রমনা ভূমি অফিস ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিস পাঠায়। নোটিসের পরপরই জমি অধগ্রহণের গেজেটও জারি করা হয়। 

গেজেট জারির কিছু দিন পর জমির ভোগদখলকারী সিরাজুল হকের পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রশাসন। পরে ওই গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন হাইকোর্টে ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিরাজুল হকের স্ত্রী মালেকা সিরাজ। শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১১ সালে গেজেট বাতিল ও জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। 

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তখন চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেন। পরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে ২০১২ সালে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তারপর আট বছর পেরিয়ে গেলেও মামলাটি শুনানির উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ।

শুধু এই তিনটি ঘটনাই নয়, দেশের নানা প্রান্তে সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। জমি উদ্ধারে মামলা করেও হারছে সরকার। নিন্ম আদালতে হেরে উচ্চ আদালতে আপিলও করছে না। ফলে সহজেই দখলদারদের কব্জায় চলে যাচ্ছে খাস জমি। 

মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহা, রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি, দখলদারদের সাথে সমঝোতা ও সময়মতো আপিলের কাগজপত্র না পাঠানোয় প্রতি বছর বিপুল সরকারি সম্পত্তি খোয়া যাচ্ছে। মামলা হলেও বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০ থেকে ৪০ বছর পরে আপিলের উদ্যোগ নেয়ায় উচ্চ আদালতও আপিল গ্রহণ করছেন না। 

ফলে ভূমি বেহাতের ৯৫ শতাংশ মামলায় চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপক্ষ পরাজিত হচ্ছে। আবার অধিকাংশ মামলায় বাদীপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় জোরপূর্বক সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে রাখে। অনেক সময় আদালতের হস্তক্ষেপেও কাজ হয় না। অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে সরকার অভিযান চালালে প্রতিপক্ষ আদালতে মামলা ঠুঁকে দেয়। 

চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। সরকারপক্ষীয় আইনজীবীরা তথ্যপ্রমাণ আদালতে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারপক্ষ পরাজিত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। তাদের হেরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো জবাবদিহিতাও থাকে না। এ বাস্তবতা থেকেই স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

আইনজীবীরা বলছেন, ভূমির মামলা নিন্ম আদালতে সরকার হারলে আর খোঁজ রাখে না রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল করলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। অনেক সময় আপিলের সময় পার হয়ে গেলেও মামলার খোঁজ থাকে না।  শুনানির ব্যাপারে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে এ বছরের ১৫ মে পর্যন্ত ১২ হাজার ৩৯টি সরকারি ভূমিসংক্রান্ত মামলায় নিন্ম আদালতে সরকারপক্ষ হেরেছে। 

দু’বছর আগের হিসেব অনুযায়ী, বিচারিক আদালতে দেওয়ানি মামলা রয়েছে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮টির মতো। হাইকোর্ট বিভাগে ৯৭ হাজার ৬১৬টি। আপিল বিভাগে রয়েছে ১৫ হাজার ৫৩৩টি। 

এদিকে ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশেই স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা সরকারি খাসজমি বা সম্পত্তি দখল করছে। স্থানীয় প্রশাসন দখলদারকে উচ্ছেদ করতে গেলেই তারা আদালতে মামলা করেন। 

তবে নিন্ম আদালতে ওই সব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারপক্ষের পরাজয় হচ্ছে। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে এ ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দখলদারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আদালতে সময়মতো উপযুক্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করেন না। সরকারপক্ষের আইনজীবীরাও বাদীর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

নিন্ম আদালতে হারের পর রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগে পাঠাতে হয়। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন পার করে রায়ের কপি পাঠান।  এতে একপ্রকার জোগসাজশ থাকে। 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, অকৃষি খাসজমির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৫ হাজার ৯১ দশমিক ২৯ একর। সব মিলিয়ে কৃষি ও অকৃষি খাসজমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ একর। 

তবে সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার একর অকৃষি খাসজমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সব মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। 

প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যথাযথ ভূমিকার অভাবে মামলায় সরকার হেরে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের চেয়ে প্রভাবশালীদের স্বার্থ দেখছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

এসব সরকারি খাসজমি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর ধরে ভোগ করছেন। চরাঞ্চলের আবাদযোগ্য ধানি জমিও তারা ভোগ করছেন। স্থানীয় সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও, এসিল্যান্ড ও ডিসিরা দখলদারদের সহযোগী। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তারাই খাসজমি ভোগদখলে রাখে। 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সাথে সমন্বয় সভায় কমিশনাররা জানান, অনেক এসিল্যান্ড কৃষি খাসজমি ডিসিআরের বিপরীতে একসনা বন্দোবস্তে দিয়ে আদায় হওয়া টাকা সরকারি খাতে জমা দিচ্ছেন না। তারা ডিসিআরের মুড়ি ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের কাছে জমা দিচ্ছেন না।

সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট ড. বাবরূল আমীন এ বিষয়ে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের গাফিলতিতে ভূমি হারাচ্ছে সরকার। মূলত চুক্তিভিত্তিক আইনজীবীদের দিয়ে কাজ হয় না। অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হলে চুক্তিভিত্তিক আইন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা থাকবে না। 

এর আওতায় ন্যূনতম আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে আইন কর্মকর্তা তথা উচ্চ আদালতে সহকারী, ডেপুটি ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং নিম্ন আদালতে এপিপি, জিপি ও পিপি পদে নিয়োগ পাবেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদ আর রাজনৈতিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হবে না। 

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, মামলা হারের পেছনে রাষ্ট্রপক্ষের চরম গাফিলতি রয়েছে। আর মামলা চলাকালিন মনিটরিং হয় না। বিচারিক আদালতে হারলেই অনিহা দেখা যায়। এ জন্য সরকারের উচিত যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করা এবং সময়মতো মামলাগুলোর আপলি করা ও খোঁজ খবর নেয়া।

Link copied!