Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ১২, ২০১৯, ০৫:২৮ এএম


কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

দেশের প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার ফার্মেসিতে কোনো ধরনের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অবাধে চলছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ব্যবসা। গত বছর দেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধ ছিল- সেফালোসপোরিন্স অ্যান্ড কম্বিনেশন বা অ্যান্টিবায়োটিক। এ শ্রেণির এক হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয় গত বছর। ওষুধটির বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল তিন দশমিক সাত শতাংশ। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে সর্দি, কাশির মতো জীবাণুবাহিত সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। অথচ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে নিয়মের পাশ কাটিয়েই অপব্যবহার বেড়ে গেছে অনেকটাই। ফার্মেসির দোকানদার, পল্লীচিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই নিজের মতো করে রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। কোন রোগের কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কোন মেয়াদে দিতে হবে তা না জেনেই চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। এছাড়া যেসব চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, রোগীরা পূর্ণমেয়াদে তা শেষ না করায় শরীরে যে জীবাণু থাকছে তা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে। আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছর পর এ অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণু সংক্রমণ চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকরী একটি ওষুধ। সূত্রমতে, সারাদেশে গড়ে প্রতিদিন সাত লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। কিন্তু বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে- ইতোমধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে তা ৫৬ শতাংশ মানুষের শরীরে কার্যকারিতা হারিয়েছে। এ নিয়ে আইসিডিডিআরবির গবেষণা বলছে, চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনা ও সেবন বাড়ছে। আবার একটু সুস্থবোধ করার পরই তা বন্ধ করে দিচ্ছে অনেকে। গবেষকদের শঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে কোনো এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজই দেবে না। আইসিডিডিআরবির গবেষণা আরও বলছে, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার ও প্রয়োগ বেড়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই রোগীরা ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনছেন, সেবন করছেন। অনেক সময় রোগের একটু উপশম হলে, বাদও দিয়ে দিচ্ছেন। আর এ অপব্যবহারে জটিল সংক্রামক রোগ তো বটেই সাধারণ অসুখেও আগের মতো কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সুচিন্তিতভাবে পরামর্শপত্র দিতে হবে চিকিৎসকদের, সেই সঙ্গে রোগীদেরও হতে হবে সচেতন। তা না হলে বাক্স বাক্স ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হবে না বলেও বলছেন গবেষকরা। এদিকে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন অযৌক্তিক কারণে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না হয়। তবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যাতে না হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু রোডম্যাপ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি, ইউজার্স গাইডলাইন, সব ইনস্টিটিউটের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন। সেটি নিয়েই আপাতত কাজ করা হচ্ছে।আইসিইউতে চিকিৎসাধীন কম-বেশি ২৫ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের হূদরোগ ও মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সে বছরে কত মানুষ মারা যায় তার কোনো তথ্য নেই। সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে ব্যাকটেরিয়া তা কমন ইনফেকশনে পাওয়া যায় না কিন্তু আইসিইউতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো আইসিইউতে প্রায়ই সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে অন্তত ২৫ শতাংশ রোগীর। তখন অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেয়া হয় বা শক্তিশালী কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এ রোগীগুলোর জন্য বিকল্প কিছুই থাকে না। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানান চিকিৎসকরা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের করা এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, রাজধানীতে শতকরা ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ঢাকায় মানুষের শরীরে যে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বাংলাদেশে কত মানুষ মারা যায় এমন কোনো জরিপ বা গবেষণা বাংলাদেশে নেই বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হূদরোগ ও মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এ আই জোয়ারদার। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স খুবই ভয়ের কথা। যখন তখন খাওয়ার প্রবণতা যদি আমরা রোধ করতে না পারি, তাহলে আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধের ব্যবহার বেশি। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ম্যাক্রোলাইড, দ্বিতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন ও পেনিসিলিন। এছাড়া এক থেকে চার বছর বয়সি শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহারের হার সর্বোচ্চ। গবেষণায় আরও দেখা যায়, অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে ভুল ব্যবহার বেশি। আর ভুল অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের কারণে হাসপাতালে বেশিদিন অবস্থান করতে হয়, শারীরিক জটিলতার মাত্রা বেশি হয় এবং এতে মৃত্যুর হারও তুলনামূলকভাবে বেশি। রাজধানীর ১০০টি ফার্মেসির ওপর করা বিএসএমএমইউর ‘ডিসপেনসিং প্যাটার্ন অব অ্যান্টিবায়োটিকস বাই মেডিসিন সেলারস ইন ঢাকা সিটি : ইফেক্ট অব ইন্টারভেনশন’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, সব দোকানেই ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে। অথচ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করার নিয়ম নেই। দোকানি এটা মানছেন কিনা, তা নজরদারি করার কেউ নেই। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিষয়ে জাতীয়ভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিএসএমএমইউ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে জরিপ ও গবেষণা করেছে তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিস্থিতি ভয়াবহ। জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিস্থিতি ভয়াবহ এই কারণে যে, গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি আইসিইউতে আসা ২৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। সারাদেশের পরিস্থিতি আমরা জানি না। জানার ব্যবস্থাও নেই। ভয়াবহতার অন্য কারণ হচ্ছে, দেশের প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন অনুমানের ওপর ভিত্তি করে, প্রায় নিশ্চিত না হয়েই। প্রায় দুই লাখ ওষুধের দোকানি ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছেন। আর অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অসংখ্য রোগী অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করছেন।অ্যান্টোবায়োটিকের ক্ষতির দিক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানবশরীরে অপরিমিত আ্যাান্টোবায়োটিক প্রবেশের ফলে মানুষের কিডনি-লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর বয়স্কদের চেয়ে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।