প্রিন্ট সংস্করণ॥আবদুর রহিম
মার্চ ১২, ২০১৯, ০৬:১৫ পিএম
এবার প্রশ্ন উঠল ডাকসুতেও। জাল ভোট প্রদান, সিলযুক্ত ব্যালট বাক্স উদ্ধার, ভোটদানে বাধা, প্রার্থীদের মারধরসহ নানা অনিয়ম ও অভিযোগের পর অবশেষে আসে ডাকসু ভবনে আলো। যদিও এখনো বিক্ষোভে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। যে ডাকসুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র বাঙালির মুক্তির সনদ- ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এখন এই ডাকসুর ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন। এদিকে ডাকসু নির্বাচনের একদিন আগেই ১০ মার্চ ৭৮ উপজেলায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোট স্থগিত, প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে দিয়ে। আরেকটি নির্বাচন। যে নির্বাচনের ১৫ মাস আগে থেমে যান আনিসুল হক! অবশেষে স্বপ্নবাজ মেয়রের স্থলাভিষিক্ত হন আতিকুল ইসলাম। পেয়েছেন আনিসুল হকের চেয়ে চার লাখ বেশি ভোট! যদিও গণমাধ্যমের পাতায় খবর ছিলো অতীতের চেয়ে ভোটার কম। এ নিয়েও হয়েছিলো অনেক সমালোচনা। ভোটার আছে, ভোটার নেই। ক্ষমতাসীনরা বলেছিলো, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ভোটার কম ছিলো। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলেছিলো, এখন আর কোনো ভোটেই জনগণের আগ্রহ নেই, উৎসবের লেশমাত্র নেই। তাই সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে মানুষ। অন্যদিকে ভোটের মালিকও নীরবে হাসছে বলে সচেতন মহল থেকে অভিযোগ আসে। চায়ের কাপে এখন আর রাজনীতি জমছে না। বয়স্করা আর রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রম্য করে ক্ষোভের ক্ষুধা মেটাচ্ছেন! তরুণ প্রজন্ম নির্বাচন-নির্বাসন নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। এর জন্য অনেকে বলছেন, ভোটকেন্দ্রগুলোতে এখন ক্ষমতাসীন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশই দায়ী, বাক্স ভর্তি ব্যালট কিংবা ব্যালট শেষের খবরেও অনেকে হতাশ, নারী ভোটারদের নিরাপত্তাও কোথায় যেন থেমে আছে- বলছেন সচেতন নাগরিকরা। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল ও সুশীল সমাজ ভয়াল দিক ব্যাখ্যা করেছেন। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাওয়া মানে নষ্টপথের দিকে এগিয়ে যাওয়া। উৎসাহ ও উদ্দীপনার নির্বাচনি ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলে কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। এবার ডাকসু, উপজেলা ও সিটিতে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে এমন নির্বাচনে সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। পুরো রাজনীতিতে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সচেতন মানুষ ও তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে এখন নেতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করছে। এভাবে, এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ ও ভোটের চিত্র চলতে থাকলে দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। দেশের কয়েকজন রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ দৈনিক আমার সংবাদের মুখোমুখি হয়ে আরও বলেন, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগ করতে না পারলে বিরোধী শক্তির মৃত্যু হবে। গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। এর ফলে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উদয় হবে। সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কারণ আমাদের অজানা এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কে বা কারা, কোন আদর্শের লোকজন তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয়ে আসেন! কারণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে যে রাজনীতি তাতে নারী ও তরুণ সমাজ খুবই বিরক্ত। দিন দিন তরুণরা নানা রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে আদর্শিক রাজনীতি থেকেও বিমুখের বড় শঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করেছে দৈনিক আমার সংবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, নির্বাচন শব্দটা বন্ধ করা অতীব প্রয়োজন, কেননা বাংলাদেশে নির্বাচন নামে যে প্রহসন চলছে তাতে এই শব্দটি কলঙ্কিত হচ্ছে। তাই নির্বাচন নামের শব্দটিকে নির্বাসন নামে ডাকুন। আরও এক তরুণ বলেন, এখন নির্বাচনি কেন্দ্রগুলো হয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের সমন্বয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, যেটা মানুষের কাছে একধরনের অস্বস্তি ও ভীতিকর পরিবেশ। উৎসবমুখর পরিবেশ ছাড়া মানুষ কখনোই আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে যাবে না। ডাকসু নিয়ে জানতে চাইলে প্রসঙ্গ থেকে বের হয়ে সাহনাজ নেক্সিব নামের আরেক তরুণ বলেন, ২০১০ সালে ভোটার হয়েছি এখনো পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে ভোটপ্রদান করতে পারিনি। যতবার ভোট দিতে গেছি ততবারই ভোটকেন্দ্রের দরজা থেকে অপমান হয়ে বাড়ি ফিরেছি। এজন্য এখন ভোটের নাম শুনলেই চরম ভয় করি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে আরেক তরুণ বলেন, আমার এলাকায় জাতীয় নির্বাচনে নারীরা ভোট দিতে গেলে তাদের বলা হয়, আপনাদের কি খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই? ছেলেমেয়েদের রেখে কেন আসছেন? বাড়ি চলে যান। আর পুরুষ ভোটারদের তো সে-কি দৌড়ানি। এতকিছুর পর মানুষ কি আর ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পায়? তাই ওইদিনের চিন্তা এবারের সিটি ভোটেও ছিলো। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কুয়েত মৈত্রী হলের সাদিয়া নওশিন নামের এক ছাত্রী বলেন, রাতে ম্যাডামের সঙ্গে ৩৮টি সিল মেরেছি হলের সিট বাঁচাতে কিন্তু সেই ভোট ভোরের আলো পেতে দিইনি। তার আগেই আটকে দিয়েছি। জাতীয় নির্বাচনে আমি ভোট দিতে পারিনি কিন্তু ডাকসুর ভোট রক্ষা করেছি। দেশের চলমান রাজনীতিকে হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন সামপ্রতিক একটি প্রবন্ধে বলেন, নির্বাচন কমিশন যত যা-ই বলুক না কেন, এই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলো বেশিরভাগ সময় খালি থেকেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি। কারণ, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মানুষ নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের ছায়া হিসেবে দেখেছে। ফলে তারা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আমাদের দেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা যতটুকু দাঁড়িয়েছিল, তা খারাপ হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে ভোটাররা আর এর ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। ভোট মানেই যে একটি উৎসাহ ও উদ্দীপনার ব্যাপার, তা কিন্তু দেশ থেকে নষ্ট হয়ে গেল। এটা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হলো না।এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকারক। নির্বাচনে বিজয়ী ব্যক্তি হয়তো দায়িত্ব বুঝে নেবেন, শপথ নিয়ে নিয়মিত দায়িত্বও পালন করবেন। কিন্তু দেশের যে মৌলিক ক্ষতিটি হয়ে গেল তা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে সিস্টেম বা ব্যবস্থার প্রতি একধরনের অদৃশ্য অনাস্থা থেকে যাবে। এটা একটি দেশের জন্য বিপজ্জনক।দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে তরুণদের মনোভাব কি তা ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, এদেশের নির্বাচনে তরুণ মনোভাব কী তা ইতোমধ্যে তরুণরা জবাব দিয়েছে। তরুণরা কী চায় এটি আর বলার কিছুই নেই। রাজনীতিবিদরা বোঝার চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রুহিন হোসেন প্রিন্স দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, পুরো রাজনীতিতে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সচেতন মানুষ ও তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে এখন নেতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী দুটি রাজনৈতিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ।ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ডাকসু নির্বাচনে যা হলো তা গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ফের কলঙ্কিত করেছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সরকারের সময়ও ডাকসু নির্বাচনে এমন কলঙ্ক হয়নি। সরকারের যে নির্বাচনি সংস্কৃতি তা রুখে দেয়ার সময় এসেছে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন তিনি। ঢাবির কুয়েত মৈত্রী হলের ভোট জালিয়াতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনা গোটা জাতির জন্য বড় লজ্জার। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান গোটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পারেনি। সেলিম বলেন, ২৮ বছর পর শিক্ষার্থীরা তাদের মতের প্রকাশ ঘটানোর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু নির্লজ্জভাবে অন্যান্য নির্বাচনের মতো এখানেও জালিয়াতি করা হলো। এটি কলঙ্কিত করল ডাকসুকে। প্রগতিশীলদের ব্যানারে ডাকসু নির্বাচনে বারবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিজয় হয়েছে মন্তব্য করে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।