Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

এক মণ দুধে এক ফোঁটা চোনা!

প্রিন্ট সংস্করণ॥মহিউদ্দিন খান মোহন

মার্চ ১২, ২০১৯, ০৬:২৭ পিএম


এক মণ দুধে এক ফোঁটা চোনা!

আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ- ‘এক মণ দুধে এক ফোঁটা চোনা’। এর মর্মার্থ হলো- এক মণ দুধের মধ্যে একফোঁটা চোনা, মানে গরুর এক ফোঁটা মূত্র পড়লে তা যেমন আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না, তেমনি কোনো ভালো কাজ বা উদ্যোগে সামান্য ত্রুটি সে কাজের মহিমাকে ভূলুণ্ঠিত করে দিতে পারে। গত পরশু অনুষ্ঠিত ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ উপমা ব্যবহার করা বোধকরি অসঙ্গত হবে না। কেননা, ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে সহাবস্থান দেখা গিয়েছিল এবং তারা যে সংযত আচরণ করেছে তাতে একটি অবিতর্কিত নির্বাচন প্রত্যাশা করছিলেন সবাই। বিশেষত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাস এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সহযোগিতার অঙ্গীকার সবাইকে আশান্বিত করে তুলেছিল। কিন্তু গত সোমবার ডাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তা দেশবাসীকে হতাশ করেছে। নির্বাচনে অনিয়ম হবে না বলে যারা আশা করেছিলেন, তারা হতাশ হয়েছেন। সকালেই যখন খবর এলো বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট দেয়া বস্তাবন্দি ব্যালট পেপার উদ্ধার করা হয়েছে, তখনই সংশয় সৃষ্টি হয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে। একে একে খবর আসতে থাকে ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের ভোটদানে বাধা দান, রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে একজন ভিপি প্রার্থীর প্রহূত হওয়ার খবর ইত্যাদি। এরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাজন নানা রকম মন্তব্য করতে থাকেন। দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকের সম্পাদক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন- ‘অতি উৎসাহীরাই সবসময় সর্বনাশ ডেকে আনে’। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সাংবাদিক লেখেন- ‘এমনটা না করলেই কী হতো না?’ আরেকজন বর্তমান সরকার সমর্থক সাংবাদিকের মন্তব্য- ‘জাতীয় নির্বাচনের ভূত ডাকসুতে’। এছাড়া রাতে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান ভোটের সময় সংঘটিত ঘটনা এবং তা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ছাত্রজীবনে তিনিও ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।ডাকসুতে এবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির বিজয়ের ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন। এরকম ধারণার কারণ, ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল বলতে গেলে দশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে। আর তাদের সাংগঠনিক শক্তিও আগের মতো নেই। নির্বাচনের জন্য তেমন প্রস্তুতিও ছিল না। ফলে এর পুরো সুবিধাটা যাওয়ার কথা ছাত্রলীগের পক্ষে। সে হিসেবে সবাই মনে করেছিলেন, বিজয় নিশ্চিত জেনে ছাত্রলীগ সংযত আচরণ করবে এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়- এমন কোনো তৎপরতা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তারা যেন তীরে এসে তরী ডোবালো। বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসুর এ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে যে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল তা হঠাৎ দমকা বাতাসে নিভে গেল। সংঘটিত ঘটনাবলীতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক ছাত্রনেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকসহ সচেতন নাগরিকরা। ডাকসুর সাবেক ভিপি বর্তমানে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ‘আইয়ূব-ইয়াহিয়ার আমলেও ডাকসুতে এমন নির্বাচন হয়নি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে’। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাচনে অনিয়ম কিছু হয় জানি। শতভাগ স্বচ্ছ নির্বাচন আশা করি না। কিন্তু যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন, সেখানে সামান্যতম অনিয়মও গ্রহণযোগ্য নয়’। এদিকে দৈনিক আমার সংবাদে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষকের যে মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তারা বলেছেন, ভোটের দিন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র এবং ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। পর্যবেক্ষণকালে তাদের দৃষ্টিতে যেসব অনিয়ম ধরা পড়েছে সেগুলো হলো- ভোটার আইডি চেক করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারা অনাবাসিক ছাত্রদের ভোট দিতে বাধা প্রদান বা নিরুৎসাহিত করেছে। ছাত্রলীগ কর্মীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করলেও বিরোধী প্যানেলের প্রার্থী ও সমর্থকরা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে অযথা জটলা সৃষ্টি করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শ্লথ করার চেষ্টা করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে শোডাউনও করতে দেখা গেছে। এটা অনেকটাই দৃশ্যমান ছিল যে ছাত্রলীগ ডাকসু জিতে নেয়ার জন্য একরকম মরিয়া ছিল। অথচ এমনটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ফলাফলে কী দেখলাম আমরা? ছাত্রলীগের জয়-জয়কার। ডাকসুতে ভিপি ও অন্য একটি পদ ছাড়া সবকটি তাদের দখলে। আর ১৮টি হল সংসদের মধ্যে ১২টিতে ভিপি এবং ১৬টিতে জিএস পদে তারা জয়লাভ করেছে। ভোট যদি সুষ্ঠু হতো, অর্থাৎ সব ভোটার যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারতো, তাহলে ফলাফলে হয়তো কিছুটা হেরফের হতো। তবে, তাতে ছাত্রলীগের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল না। আর নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার থেকে অনিয়মের অভিযোগ সত্য বলেই অনুমিত হয়। অতীতে ডাকসু নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতো। এবার তা ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা কী ভোটের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনীহা, নাকি তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ভোট দিতে পারেনি? অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে ছাত্রদলসহ ছয়টি প্যানেল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করে। তারা ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটেরও ডাক দিয়েছিল। সচেতন ব্যক্তিরা এটাকে অশনি সংকেত হিসেবেই দেখছেন। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আবার অশান্ত হয়ে উঠে কিনা এ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থী স্বার্থ সংরক্ষণ পরিষদ থেকে নূরুল হক নূরুর ভিপি নির্বাচিত হওয়াকে মেনে নিতে পারছে না ছাত্রলীগ। তারা ভিপি পদের ফল বাতিলের দাবি তুলে ভিসির বাসার সামনে বিক্ষোভও করেছে। সবমিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর আবার মুখোমুখি অবস্থান নেয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ডাকসু নির্বাচন ক্যাম্পাসে শান্তি ও সহাবস্থানের আবহ সৃষ্টি করবে- এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু অতি উৎসাহীদের অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতা সে প্রত্যাশার গুঁড়ে মুঠো মুঠো বালি ছড়িয়ে দিল কিনা কে জানে!