Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ অবৈধ

প্রিন্ট সংস্করণ॥বিশেষ প্রতিবেদক

মার্চ ১২, ২০১৯, ০৬:৩৩ পিএম


গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ অবৈধ

আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের যুক্তি বর্তমানে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে দেয়া হচ্ছে। আগামী এপ্রিল থেকে দৈনিক আরও ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি থেকে পাওয়া যাবে। এজন্য বছরে ২৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ঘাটতি হবে, যা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হবে।দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে আবাসিকে একচুলা বর্তমান দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩৫০ টাকা, দুই চুলা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৪৪০ টাকা, সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার ২ দশমিক ৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৪৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ০৪ টাকা, শিল্পে ৭ দশমিক ৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ দশমিক ০৫ টাকা, বাণিজ্যিকে ১৭ দশমিক ০৪ টাকার পরিবর্তে ২৪ দশমিক ০৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।এদিকে শুনানিতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩ দশমিক ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৪ টাকা, সিএনজিতে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ১০ টাকা, প্রি-পেইড মিটারে ৯ দশমিক ১০ (ঘনমিটার) টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৪১ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।একইসঙ্গে বিতরণ চার্জ বাড়ানোর জন্যও প্রস্তাবনা দিয়েছে তিতাস গ্যাস। তবে চলতি অর্থবছর সমাপ্তির পর প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে তিতাসের বিতরণ চার্জ বৃদ্ধি করা যৌক্তিক হবে বলে জানিয়েছে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি।শুনানিতে অংশ নিয়ে বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক দাবি করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোরযৌক্তিক পূর্বাভাস দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, কিছুদিন পরপর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। এতে করে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মুখথুবড়ে পড়বে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের ওপর অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক গণশুনানির প্রথম দিন গত সোমবার এসব বক্তব্য উঠে আসে। এ শুনানি চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। কারওয়ান বাজারের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) অডিটরিয়ামে এই শুনানির আয়োজন করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।পেট্রোবাংলার দাবি, প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হলে বছরে ২৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ঘাটতি হবে। এ ঘাটতি পূরণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে আবেদন জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু ভোক্তা প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে বলেছেন, গ্যাস সরবরাহ করার আগেই দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ অবৈধ। প্রথমে দাম বৃদ্ধির পক্ষে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপর গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (জিটিসিএল) সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি হয়। শুনানির শুরুতে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, আগামী এপ্রিল থেকে নতুন করে এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। তাই গ্যাসের দাম সমন্বয় করা দরকার। শুনানিতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেন, দেশে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের জন্য এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। তাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ঘাটতি মেটাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৬৬০ কোটি টাকা দরকার ছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগ পেট্রোবাংলাকে কোনো অনুদান দেয়নি। এছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংকে পর্যাপ্ত ডলার সঞ্চিত না থাকায় বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এভাবে অর্থায়নের ফলে ব্যয় বাড়ছে।দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুট দেশীয় গ্যাস সরবরাহ করা হয়। উৎপাদন পর্যায়ে যার ইউনিটপ্রতি ঘনমিটারের দাম পড়ছে গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ টাকা। এলএনজির আমদানি দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছালে সরবরাহ পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটারের দাম হবে ৪১ টাকা ২৫ পয়সা। বর্তমানে গড়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে সাত টাকা ১৭ পয়সা দরে। ঘাটতি মেটাতে এর সঙ্গে ৯ টাকা ৫৫ পয়সা এলএনজি চার্জ হারে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। শুনানিতে জিটিসিএল তাদের বিদ্যমান হুইলিং চার্জ প্রতি ঘনমিটারে ৪২ পয়সা বাড়িয়ে ৫৬ পয়সা করার আবেদন করেছে।পেট্রোবাংলার লিখিত আবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের কোম্পানি বিজিএফসিএলের কাছ থেকে ৭৭২ এমএমসিএফডি গ্যাস ৭০ পয়সা হারে (ঘনমিটার), বাপেক্সের কাছ থেকে ৩ টাকা ৪ পয়সা হারে ১০৮ এমএমসিএফডি, এসজিএফসিএল-এর কাছ থেকে ২০ পয়সা হারে ১২৪ এমএমসিএফডি, আইওসির কাছ থেকে ২ দশমিক ৫৫ টাকা হারে ১ হাজার ৭১২ এমএমসিএফডি গ্যাস কেনা হচ্ছে।শুনানিতে শিল্প বণিক সংস্থা (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গ্যাসের দাম না বাড়ানোর আবেদন জানিয়ে বলেন, যদি আমরা এমডিজির মতো সাফল্য অর্জন করতে চাই শিল্পে কর্মসংস্থান ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য ৭০ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রয়োজন। সরকার অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের স্বল্পমেয়াদি শিল্প উন্নয়ন নীতি অগোছালো। তবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নীতি বেশ ভালো। তিনি বলেন, শুধু দাম বাড়ানোর সময় আমাদের ডাকা হবে আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না, এটি ঠিক নয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে গড় গ্যাসের দাম ছিল ৬ দশমিক ৯ ডলার। গত কয়েক বছরে মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের ২৯ ভাগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হয়ে যাবে। এছাড়া নতুন শিল্প উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। এতে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। বিজিএমইএ-র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিশ্বে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কমেনি। আবেদন করার পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সবেমাত্র গ্যাস সংযোগ পেতে শুরু করেছে। এখন এই দাম বৃদ্ধি কার স্বার্থে করা হচ্ছে? তিতাসের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা ৩৫ ভাগ লভ্যাংশ দিতে চাচ্ছেন কিন্তু আমরা তো দুই-তিন ভাগও ব্যবসা করতে পারছি না। তিনি গণশুনানিকে হাস্যকর আখ্যা দেন। বিটিএমএ-র সভাপতি মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, গার্মেন্ট শিল্প যে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে তার পেছনে আমাদের ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। আপনারা বারবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করছেন কিন্তু আমরা যে ইভিসি (ইলেকট্রিক ভলিউম কারেকটর) মিটার চাচ্ছি তা দুই থেকে তিন বছরেও দিতে পারেননি। ফলে গ্যাসের নিম্নচাপ, অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ, গ্যাসের প্রকৃত ব্যবহারের চেয়ে বিল বেশি দিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাবি বিইআরসির কাছে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের।কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আগামী এপ্রিলে এলএনজি আসতে পারবে না। এই বিষয়টি সরকার যেমন জানেন, বিইআরসিও তা বোঝে। কিন্তু তারপরও যে গ্যাস আসেইনি সে গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে তা অযৌক্তিক ও অন্যায়। এই ভিত্তিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসির আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ভোক্তার ঘরে পৌঁছে দেয়ার আগে কোনোভাবেই দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। সরকার যতদিন অর্থ না দেয় ততদিন সে তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে এলএনজির ব্যয় নির্বাহের আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবটি বাতিলের দাবি জানান। এর জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, দাম সমন্বয়ের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ বিষয়। এজন্য আমদানির উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে মূল্য সমন্বয়ের কার্যক্রম চলছে। এর মানে এটা নয় যে, আগেই গ্রাহকদের বাড়তি দাম দিতে হবে। যখন গ্যাস আসবে তখন মূল্য সমন্বয় কার্যকর হতে পারে।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি খাতে চুরি খুবই বড়। চুরি ঠেকাতে না পারলে ভালো কিছু সম্ভব নয়। বিইআরসি গ্যাসের খুচরা দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু উৎপাদন পর্যায়েও দাম নির্ধারণের দায়িত্ব তার থাকা উচিত। তিনি জ্বালানি ও বিদ্যুৎজনিত দুর্ঘটনার পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের পরামর্শ দেন।অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, তেল-গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির তেমন উদ্যোগ নেই। সরবরাহ না বাড়লে দাম তো বাড়বেই। জ্বালানি খাতকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে কমিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে বিইআরসির সমালোচনা করেন তিনি।বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা অতীতে অনেকবার এখানে এসে প্রতিবাদ করেছি, কিন্তু দাম ঠিকই বাড়ানো হয়েছে।শুনানিতে অংশ নিয়ে দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ বাতিলের দাবিতে আরও বক্তৃতা করেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নুর প্রমুখ। এছাড়া দাম বাড়ানোর কার্যক্রমের প্রতিবাদে সাধারণ নাগরিক সমাজ নামের একটি সংগঠন টিসিবি ভবনের সামনে সকালে মানববন্ধন করে। শুনানির শেষ দিকে কমিশনের সদস্য আবদুল আজিজ বলেন, জ্বালানি যত আমদানিনির্ভর হবে, দাম তত বাড়বে।