Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

উদাসিনতায় অপূরণীয় ক্ষতি

প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ

মার্চ ২৮, ২০১৯, ০৭:৪৪ পিএম


উদাসিনতায় অপূরণীয় ক্ষতি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্ভার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ‘শত শত কোটি টাকার পণ্য’ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে নিলেও সে বিষয়ে কিছুই জানা ছিল না এনবিআরের। সার্ভার হ্যাকিং এখন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সাথে সাথে যদি সার্ভারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করা যায় তাহলে এই ডিজিটাল ব্যবস্থা লাভের চেয়ে ক্ষতিই বয়ে আনবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এর আগে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকাররা চুরি করে নিয়ে যায়। এই রহস্যের সমাধান এখনো হয়নি। এর মধ্যেই জন্ম হলো আরেকটি ঘটনার। এতে সার্ভারের অনিরাপত্তার বিষয়টি আবারো সামনে এলো। তবে এনবিআর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, তারা তদন্তের মধ্য দিয়ে দোষীদের বের করে সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে পারবে। সেটাও কতটুকু হবে এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত তিন বছরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মূলহোতারা ঘটনার আড়ালেই রয়ে গেল। তবে এনবিআর কর্তৃপক্ষ বলছে তারা ইতোমধ্যেই জালিয়াত চক্রটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শহিদুল ইসলাম এমনটিই জানিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে চক্রটি চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সংশ্লিষ্টতার নথিপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে, মামলা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে একটি তদন্ত টিম কাজ করছে। এনবিআরের সার্ভারে অনুপ্রবেশ বা হ্যাকিংয়ের ঘটনা তুলে ধরে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সরকারি আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য পাচারে জড়িত সংঘবদ্ধ একটি চক্র তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই সার্ভারের অবৈধ ব্যবহার করেছে। আর এ সময়ে চক্রটি শত শত কোটি টাকার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করে নিয়েছে। শহিদুল জানান, জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের ঘটনায় রমনা থানায় গত ১৬ জানুয়ারি একটি মামলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৩০টি কনটেইনার ছাড় করা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ রয়েছে। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। জানার পর আমরা এর তদন্তে কাজ করে যাচ্ছি। পণ্য খালাসে জড়িত দুটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিককে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। তারা হলেন- মো. মিজানুর রহমান চাকলাদার ওরফে দীপু ও অপু চাকলাদার। অধিদপ্তরের তদন্ত দলের প্রধান আবদুল হাকিম বলেন, এই ঘটনায় ২২টি পণ্যের চালান বেরিয়ে গেছে। যেখানে ঘোষণা ছিল স্টিল জাতীয় পণ্যের। তবে কি জাতীয় পণ্য বেরিয়ে গেছে তা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে অভিযোগ রয়েছে সিগারেট ও মাদক জাতীয় পণ্যের। আরও পণ্য এভাবে বেরিয়ে গেছে কিনা তা তদন্ত শেষে বলা যাবে। জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের ঘটনায় আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কমিটি ছাড়া আরও তিনটি কমিটি কাজ করছে বলে জানান মহাপরিচালক শহিদুল ইসলাম। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তদন্ত কমিটির প্রধান কমিশনার (আপিল) ফখরুল আলম, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) কমিটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসের গঠিত কমিটির প্রধান যুগ্ম কমিশনার এইচএম শরিফুল হাসান। হ্যাকিংয়ের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সরকারি আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য পাচারে জড়িত সংঘবদ্ধ একটি চক্র তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই সার্ভারের অবৈধ ব্যবহার করেছে। আর এ সময়ে চক্রটি শত শত কোটি টাকার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করে নিয়ে গেছে। ২০১৬ সাল থেকে ৩ হাজার ৭৭৭ বার লগইন করেছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক তদন্তে ধরা পড়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয় জাল করা হয়েছে চিঠিও। আর এতে চট্টগ্রাম কাস্টম, বন্দর কর্তৃপক্ষের যোগসাজস ছিল বলে জানা গেছে। মামলা মাধ্যমে জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় ৩০টি কনটেইনার ছাড় করা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ রয়েছে। এসব কনটেইনারে লোহা ও ইস্পাত পণ্য ছিল বলে ঘোষণা দেয়া ছিল। তবে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, কনটেইনারগুলোতে বিদেশি সিগারেট, দামি মদ ও পোশাক কারখানার কাপড় ছিল। এ ঘটনায় কি পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে প্রতারক চক্রটি এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না। তদন্ত শেষের পরই ক্ষতির পরিমাণ বলা যাবে বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহিদুল ইসলাম। সিআইডির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুই ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে চালানগুলো খালাস করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি চালান ছাড় করানো হয় দুজন কাস্টমস কর্মকর্তার চুরি করা আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। আর ১০টি চালান ছাড় করানো হয়েছে একজন কাস্টমস কর্মকর্তার চিঠি জাল করে। এর মধ্যে দুটি চালানে দুই ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তে আইডি, পাসওয়ার্ড চুরি ও চিঠি জালিয়াতি করে পণ্য আমদানি ও ছাড় করানোর ঘটনায় ২০ আমদানিকারক ও ১০ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করার পর তার শুল্কায়ন থেকে শুরু করে সবকিছুই হয় এনবিআরের ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’ নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। দেশের সব বন্দর এই সফটওয়্যারের আওতায় কাজ করে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় কাকরাইলে এনবিআরের কার্যালয় থেকে। কোনো চালান ছাড়তে না চাইলে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেটা বন্ধ করারও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছে এমন খবরে তারা আমদানি করা ২২টি কনটেইনার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ছাড় করানো বন্ধ (লক) করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেই কনটেইনারগুলো নামমাত্র শুল্ক দিয়ে ছাড় করানো হয়েছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে কর্মকর্তারা দেখতে পান, রাজস্ব বোর্ডের সফটওয়্যার থেকেই এসব চালান ছাড় করে দেয়া হয়েছে। আর এ জন্য ব্যবহার করা হয়েছে দুজন কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড। কিন্তু এই দুই কর্মকর্তার কেউই বন্দরে কর্মরত নেই বর্তমানে। তারপরও কীভাবে ঘটল এমন ঘটনা সেটাই এখন রহস্য। গত তিন বছরে এই আইডি দুটি পণ্য খালাসের জন্য অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ৩ হাজার ৭৭৭ বার অবৈধভাবে ব্যবহূত হয়েছে। যে দুই কর্মকর্তার নামে আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পণ্য খালাস করা হয়েছে তারা হলেন- ডি এ এম মহিবুল ইসলাম ও ফজলুল হক। মহিবুল ইসলাম ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে চাকরি শেষে অবসরে যান। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড় বছর তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে ছিলেন। আর ফজলুল হক ২০০৯ সাল থেকে (এক বছর বাদে) ২০১৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত ছিলেন। নিয়ম অনুসারে, একজন কর্মকর্তা বন্দরে নিয়োগের পর পদ ও দায়িত্ব বিবেচনা করে তার নামে আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরি করে দেয়া হয়। আর কর্মকর্তারা কর্মস্থল ত্যাগ করার সময় লিখিতভাবে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানালে সেই আইডি বন্ধ করে দেয়া হয়। দাপ্তরিক নিয়ম মেনে তারা আইডি বন্ধ করার চিঠি দিলেও কেন তাদের আইডি বন্ধ করা হলো না এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলেনি এনবিআরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এখন সবার মুখে জবাব একটাই- তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করুন। মামলার নথিতে দেখা গেছে, মহিবুল ইসলাম চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে আসার পর তার আইডি ১১৬ বার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম লগইন করেছে। আর ফজলুল হকের আইডি লগইন করেছে ৩ হাজার ৬৬১ বার। মহিবুল ইসলামের আইডিটি বন্ধ করার পর ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর আবার চালু হয়ে ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সচল ছিল। ফজলুল হকের আইডি চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সচল ছিল। দুটি আইডি শুধু চট্টগ্রামে নয়, ঢাকার ছয়-সাতটি স্থান থেকেও লগইন করা হয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, শুধু চট্টগ্রামে নয়, এই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কমলাপুর আইসিডি ও অন্যান্য বন্দর থেকেও পণ্য ছাড় করানো হয়েছে। কর্মকর্তা না থাকার পরও এতদিন কী করে আইডি সচল থাকে এটাই এখন জনমনে প্রশ্ন। আইডি ও পাসওয়ার্ড জালিয়াতির পাশাপাশি পণ্যও খালাস করা হয়েছে জাল চিঠি ব্যবহার করে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ১০টি কনটেইনারে পণ্য আমদানির খবরে সতর্ক করে তারা চট্টগ্রাম বন্দর ও পণ্য পরিবহনে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেককে গত বছরের ৪ এপ্রিল চিঠি দেন। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা যায়, আমদানিকারকরা কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই নামমাত্র শুল্ক দিয়ে এগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। চট্টগ্রাম বন্দর ও সাইফ পাওয়ারটেক এতে কোনো আপত্তিও করেনি। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেখতে পান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে চিঠি দিয়ে পণ্যটি ছেড়ে দিতে বলার পরই সবাই তা ছেড়ে দেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত টিম খুব দ্রুতগতিতে কাজ করছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন।