Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আগুন আতঙ্কে দেশের জনগণ

প্রিন্ট সংস্করণ॥ফারুক আলম

মার্চ ৩০, ২০১৯, ০৬:১২ পিএম


আগুন আতঙ্কে দেশের জনগণ

*দেশের ৯৭ ভাগ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি
*রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস আইন সাংঘর্ষিক
*আইনের কঠোর বাস্তবায়ন চান ডিএসসিসির প্রধান পরিকল্পনাবিদ
*অগ্নিকাণ্ডের দায় সরকারের; বললেন পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ

অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসে শত থেকে হাজারো মানুষের মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যুর যেনো নেই কোনো গ্যারান্টি। বছরের পর বছর এ মৃত্যুর দায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এড়িয়েই যাচ্ছেন। তাদেরকে এসব মৃত্যু যেন ছুঁতেই পারছে না। এটি দিন দিন যেন নিয়ম মাফিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যার সমাধান যদি এখনই না করা যায় তবে ভবিষ্যতে এটি জাতির জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।তারা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর পরের তথ্যটি হলো- গাড়িটি ফিটনেসবিহীন, ড্রাইভারের লাইসেন্স নেই। ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতের পর- ভবনটি নকশা বহির্ভূত, ভবন ধসের পর ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে চলতে থাকলে জাতি ফের রানাপ্লাজা, নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর পুনরাবৃত্তি দেখবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই লাখো থেকে কোটি মানুষ বসবাস করছেন এই মহানগরীতে। এখনো সময় আছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নিশ্চিত করার। এজন্য সরকারকে অবশ্যই প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরকে নিয়ম-নীতির মধ্যে আনতে হবে। নিয়মের ভেতর আনতে হলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ক্ষতি হলেও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ভবনের অনুমোদন, নকশা, ফায়ার সেফটি, বিল্ডিং সেফটির কাগজপত্র। ফায়ার এস্কেপ হিসেবে সিঁড়ি এবং অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ভবনের নিচে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।চলতি বছর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭১ জনের মৃত্যুর এক মাসের মাথায় বনানীতে ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঝরে যায় ১২৪টি প্রাণ। এছাড়া ২০১৩ সালে সাভারের রানাপ্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। প্রতিবছর এভাবে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হয় আর কবে প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পাচ্ছেন সেটিও কারো জানা নেই। প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পেলে অন্যসব অপরাধীরা বা যিনি অনিয়মের কথা ভাবছেন তারা ভয়ে থাকতেন।কোনো ভবন ব্যবহার বা বসবাসের আগে সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রেখে প্রণয়ন করা হয় ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮। তবে এ নিয়মের অস্তিত্ব শুধু কাগজ-কলমেই। ইমারত বিধিমালা কার্যকরের পর রাজধানীতে গত ১০ বছরে নির্মাণ হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি ভবন। অবশ্য রাজউক থেকে ব্যবহার বা বসবাসের সনদ সংগ্রহ করেছেন ২০০টিরও কম ভবনের মালিক। শুধু বনানীর এফআর টাওয়ারই নয়, ঢাকা মহানগরীসহ দেশের ৯৭ ভাগ বহুতল ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ফায়ার সার্ভিসের কোনো ছাড়পত্র নেই।এ ব্যাপারে রাজউকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অধিকাংশ মালিকরা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করায় অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন না। আর অনুমোদিত নকশা ছাড়া ভবন বানানোর অভিযোগে হা-মীম গ্রুপের মালিক এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদের গুলশানের বাড়ির সামনের একটি অংশ ভাঙতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে ফিরে আসে রাজউক। শুধু এখানেই নয়, এই ধরনের শত শত ভবন মালিক রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করেছেন। এসব ভবনের মালিক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী কিংবা হাউজিং কোম্পানির। ভাঙতে গেলেই চাকরিচ্যুতির ঘটনা ছাড়াও জীবননাশের হুমকি থাকে। তাই বাধ্য হয়ে ভবন না ভেঙেই ফিরে আসতে হয় তাদের।রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (রাজউক) আবদুর রহমান বলেন, শতভাগ নিয়মের মধ্যে ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা রাজউক এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট রাজউকের নতুন বিধিমালায় যুক্ত হয়েছে। এখন বহুতল ভবন মালিকদের এ সার্টিফিকেট নিতে বাধ্য করা হবে। সার্টিফিকেট ছাড়া পরিষেবা সংযোগ না দেয়ার বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করব আমরা।ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান। তারা দেশ ও পরিবারের অমূল্য সম্পদ। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিশ্চিতে অবশ্যই আইনের কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যে দায়িত্ব দেয়া আছে সেটি পালন করতে হবে। তাহলে আগুনে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, রাজউক চেয়ারম্যান স্টেটম্যান্টে বলেছেন, অবৈধ ভবন নির্মাণের দায় রাজউক এড়িয়ে যেতে পারে না। বনানীর এফআর টাওয়ার ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা একদিনে হয়নি। রাজউকের চোখের সামনে কিভাবে বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে লাগানো অবৈধ ভবন নির্মাণ হয়। এছাড়া বসবাসের জন্য ভবনের প্রতি ৫ বছর পর পর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়। যারা এই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নেবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। সরকারের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা যদি অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ না করেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন আইনের গতিতে চলবে। আইন অনুযায়ী মানুষের জীবন সেভ করার দায়িত্ব সরকারের। সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ভবন বসবাসের উপযোগী কিনা সেজন্য ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো উত্তরা কিংবা আব্দুল্লাহপুরের যেকোনো একটি জায়গা থেকে অভিযান চালাতে পারেন। দু-চারজন ভবন মালিককে জরিমানা করলেই অন্য সবাই তাদের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ঠিক করে নেবে। এতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সচেতনতা দুটোই প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, রাজউক চেয়ারম্যান অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের বিষয়টি নতুন বললেও এটি মূলত ১১ বছর আগে রাজউকের ২০০৮ সালের আইনে বলা আছে। কিন্তু রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে এসি আছে কিন্তু আলো, বাতাস ও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। ভবন তৈরির প্রক্রিয়ায় গলদ। এজন্য পুরো ইরামত নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য সংস্থাগুলোর নজরদারি, সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকারের সুযোগ নেই অন্যের ওপর দোষ চাপানোর। কারণ ক্ষমতাসীনরা টানা ১০ বছর পেরিয়ে ১১ বছর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে আছে। আর রাজউক ও ফায়ার সার্ভিস সরকারেরই একটি সংস্থা। কিন্তু তারা এখনো ভবন নির্মাণের অনিয়ম দূর করতে পারেনি। আগুনের সব দায়দায়িত্ব সরকারের বলে মনে করেন এই পরিকল্পনাবিদ।রাজউকের কিছু অসাধু অথরাইজড অফিসারকে ঘুষের বিনিময়ে ভবনের আশপাশে জমি ফাঁকা না রেখেই অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করছেন জমির মালিক ও ডেভেলপাররা। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এ বলা হয়েছে, ‘বিল্ডিং সার্ভিসেস’ অর্থ আলো-বাতাসের চলাচল, বৈদ্যুতিক সংযোগ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, উত্তাপন, অভ্যন্তরীণ শব্দ নিয়ন্ত্রণ, লিফট, গ্যারেজ, এস্কেলেটর ও মুভিং ওয়াক স্থাপন, পানি সরবরাহ, অগ্নিনির্বাপণ, পয়ঃ ও পানি নিষ্কাশন, গ্যাস সরবরাহ এবং টেলিফোন সংযোগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সুবিধার সন্নিবেশ থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ভবনে সেটি মানা হচ্ছে না।
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য আশিক ইমরান বলেন, ফায়ার সেফটির আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকলে দুর্ঘটনায় ক্ষতি কমানো সম্ভব। চট্টগ্রাম শহরে ৬০ লাখ মানুষের বসবাস, সেখানে ২০ হাজার ভবন আছে। এর ৯৩ ভাগ ভবনেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ঢাকার বনানীতে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। ফায়ার সার্ভিস দ্রুতই ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সড়কে যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো না থাকায় বিভিন্ন সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিলম্ব হয়। আগুন লাগার ঘটনায় যার অবহেলা রয়েছে তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউজ অ্যান্ড ফায়ার প্রিভেনশন) ওহিদুল ইসলাম বলেন, ভবনে আগুন লাগলেই সরকারি সংস্থাগুলোকে দোষারোপ করা হচ্ছে। ঢালাওভাবে দোষারোপ না করে প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। নাগরিকরা সচেতন না হলে কোনোভাবেই সরকারি সংস্থাগুলো দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারবে না। ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ছয়তলার ওপর যেকোনো ভবনই বহুতল। আর রাজউকের আইন অনুযায়ী, ১০ তলা থেকে বহুতল ভবন। দুই আইনের এমন সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ১০ তলার নিচের বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র চায় না রাজউক। ফলে এই ভবনগুলো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই গড়ে উঠছে।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৯০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন। এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। শুধু ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। রাজধানীর অধিকাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকলেও পোশাক কারখানায় কিছুটা রয়েছে, তাও খুবই নাজুক। সাভার ও আশুলিয়ায় ২৩২টি পোশাক কারখানা পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ কারখানার মোটামুটি, আর ৩৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ভালো ছিল।