Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ঢাকায় ঘুরছে স্বপ্নপোড়া শত্রু

প্রিন্ট সংস্করণ

এপ্রিল ১, ২০১৯, ০৫:৩৬ এএম


ঢাকায় ঘুরছে স্বপ্নপোড়া শত্রু

এই হাত, এই পা, এই পোড়া দেহ, একজন মা, একজন স্ত্রী, চক্ষু শীতল সন্তান! বারবার আমাদের দেখতে হচ্ছে লাশের সারি। সন্তানের খোঁজে, বাবার খোঁজে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে এখনো ঘুরছেন স্বজনরা। হোক সে গরিব-ধনী। প্রত্যেক স্বজনহারার কষ্টই এক। সমপ্রতি চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার এবং গুলশানের কাঁচাবাজারে লাশের মিছিলের ঘটনাস্থল সরেজমিন ঘুরে বর্তমান হাল তুলে ধরেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহিম

ওয়াহিদ ম্যানশন : আরেকটি লাশের মিছিলের অপেক্ষা
গতকাল রোববার সকাল ৯টায় চকবাজারের ওয়াহিদ ম্যানশনের চিত্র! ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবনের নিচে এখনো মানুষ চলাফেরা করছে। আশপাশের ব্যবসায়ীরা পুরনো চিত্রে ফিরে এসেছেন! চায়ের দোকান জমে আছে! ওই ভবনে এখনো নিহতদের ছবি টাঙিয়ে স্মরণ করছেন স্থানীয়রা। দূর থেকে স্বপ্ন পোড়া ভবনটি দেখতে আসছেন অনেকে। কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর আহ্বান জানিয়ে লাগানো হয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন। তবে মানুষ খুব অল্পতেই যেন সব শোক ভুলে গেছে! ওয়াহিদ ম্যানশনের পাশেই রাজমুকুট হোটেল। ওই হোটেলের উপরে রয়েছে আরো ছয় তলা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ ভবনটিও প্রায় পুড়ে গেছে। খসে পড়ছে আস্তর। স্থানীয়দের ভাষ্য, এটিও যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু সেই ভবনের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। করা হচ্ছে মেকআপ! অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে যাওয়া জায়গায় আস্তর দেয়া হচ্ছে। রঙ করার প্রস্তুতিও নেয়া রয়েছে। বাম পাশে রয়েছে জামাল সরদার কমিউনিটি সেন্টার। সেটিও এখন আগের মতোই চলছে। বিয়ে-অনুষ্ঠান সব কিছুই হচ্ছে। এর নিচে রয়েছে একটি চায়ের দোকান। সেটিও বেশ জমে আছে। ফল ব্যবসায়ীরাও আগের মতো ফল বিক্রি করছেন। মানুষও কিনছে! তবে স্বল্প এ কয়দিনের মাথায় মানুষ ওই মৃত্যুপুরী যেন ভুলে গেছে! ওইদিন চুড়িহাট্টা মোড়ের সামনে ভয়াবহ যানজটে কী হয়েছিল। বিয়ের বরযাত্রীদের গাড়িতে থাকা লোকদের কী হয়েছিল। ওয়াহিদ ম্যানশনের ভেতরে থাকা লোকদের কী পরিণতি হয়েছিল। আমার সংবাদের সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় ফিরোজ আহমদের। তিনি ওই ভবনের পাশে চা খেতে খেতে বলেন, সেদিন স্বাভাবিক যানজট আরও তীব্র ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ করেই পারফিউমের বোতলভর্তি একটি পিকআপের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ভবনের তিনতলা পর্যন্ত উঠে যায়। এতে পাশে থাকা বিদ্যুতের ছোট একটি ট্রান্সফরমারে আগুন ধরে যায়। পরে শুনেছি এ আগুনের স্পর্শে এ ভবনেরই একটি এয়ার কন্ডিশনারে (এসি) আগুন লাগে। ফলে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় ওই এসি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায়। স্থানীয় ওই ব্যক্তির ভাষ্য, পারফিউমের গোডাউনের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনগুলোয়। যে আগুন প্রায় ৮০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। এদিকে যে কোনো সময় ভবনটি ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল। এরপরও এটি কেন ভাঙা হচ্ছে না; এ নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয়রা।

এফআর টাওয়ার : নতুন করে মৃত্যুপুরীর আতঙ্ক
দুপুর ১২টা, বনানী। ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের চিত্র। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ! বলে যাচ্ছে যে কোনো সময় টাওয়ারটি ভেঙে পড়তে পারে! ওই ভবনের আশেপাশে কাউকে চলাফেরা না করতে নির্দেশনা দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আহমেদ টাওয়ারের সঙ্গে এফআর টাওয়ারের দূরত্ব প্রায় তিন ফুটের চেয়েও বেশি। নিচের অংশ এই দূরত্ব ঠিক থাকলেও এফআর টাওয়ারের উপরের অংশ আহমেদ টাওয়ারের সঙ্গে লেগে গেছে। ওই শঙ্কায় আরেক পাশের আউয়াল সেন্টারও বন্ধ রাখা হয়েছে। দীর্ঘ এলাকাজুড়ে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে কাজ করছে। আবার এর একটু দূরেই রয়েছে দুটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টায় দেখা গেছে, এফআর টাওয়ারের পাশে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঁচ দাবিতে রাস্তায় নেমে আসতে। এ সময় তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে স্লোগান ছিল এমন, ঢাকা কি লাশধানী! আগুনের পুড়ে মরতে চাই না গড়ৎব ভরৎব হড় ংবৎারপব! ফায়ার এলার্ম ও জরুরি বহির্গমন চাই, নিরাপদ বিল্ডিং চাই। শিক্ষার্থীদের লিখিত দাবিতে রয়েছে, ০১, অগ্নিনির্বাপক সকল ধরনের উন্নত সরঞ্জাম সুনিশ্চিত করা; ০২. ফায়ার এলার্ম সিস্টেম এবং জরুরি বহির্গমন পথ এর। সুব্যবস্থা সুনিশ্চিত করণ; ০৩, সিকিউরিটিতে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা এবং সকল পরিছন্নকর্মীদের অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ক সকল প্রকার ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; ০৪. অতি শীঘ্রই পার্মানেন্ট ক্যাম্পাসের নকশা বাজেট এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন; ০৫, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ন্যূনতম চারটি বাসের ব্যবস্থা করা। অবশেষে বেলা ২টার দিকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শিকদার মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম রাস্তায় এসে শিক্ষার্থীদের বলেন, তোমরা রাস্তায় নামার দরকার নেই, তোমাদের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তিনি দাবি আদায়ের আশ্বাস দেন উপস্থিত শিক্ষার্থীদের। চকবাজার ওয়াহিদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের পর বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বলেছিল- এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড হলে ভবন ধসে পড়তে পারে। কিন্তু এফআর টাওয়ার নিয়ে এখনো কোনো বিশেষজ্ঞ দল কথা বলেনি। তবে প্রায় তিন ফুট এফআর টাওয়ার হেলে পড়ায় আতঙ্কে রেয়েছে স্থানীয় এলাকার ব্যবসায়ী ও বসবাসরত মানুষরা। অনেকে মনে করছেন, হেলেপড়া ভবনটি যদি ধসে পড়ে, তাহলে ভয়াল মৃত্যুপুরীতে রূপ নেবে বনানী। আমার সংবাদের সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা রুহুল তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এফআর টাওয়ারের পেছনে একটি ভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। এ ঘটনার পর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে তিনি নরসিংদী পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার আশঙ্কা, এফআর টাওয়ার প্রায় তিন ফুট হেলে পড়েছে, তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।

গুলশান কাঁচাবাজার :গড়া স্বপ্নপোড়ায় হচ্ছে বিক্রি
বেলা আড়াইটায় গুলশান-১ এর কাঁচাবাজারের চিত্র। গড়া স্বপ্ন মানুষ যেন পোড়ায় বিক্রি করছে। সব জিনিসে পুড়ার দাগ। কালো চিহ্ন। তাই রাস্তায় ফেলে হাজারের জিনিস বিক্রি করছে ১০০ টাকায়! একশ’র জিনিস ৫-১০ টাকায় হলেও দিয়ে দিচ্ছে! আমার সংবাদের সঙ্গে কথায় হয় বেশ কয়েকজনের। রাগ আর ক্ষোভে অনেকে বলেন, শুধু বারবার এই কাঁচাবাজারে কেন আগুন লাগে! কাঁচাবাজারের দুই পাশে গুলশান শপিং সেন্টার, একপাশে ডিএনসিসি সুপার মার্কেট, আরেকদিকে রয়েছে র্যাংগস ভবন। কই এগুলো তো সবসময় সুরক্ষায় থাকে! তবে বিস্ময়করভাবে এখনো পোড়া ভবনের ভেতরে দাঁড়িয়ে কাঁচাবাজার, পোল্টি ব্যবসা এখনো চালিয়ে যেতে দেখা গেছে। আমার সংবাদের সঙ্গে কথা হয় ইলমা ট্রেডিং সেন্টারের মালিক মো. নাঈমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ মার্কেটে তার দুটি দোকান রয়েছে। যখন আগুন লাগে, তখন তিনি গাজীপুর ছিলেন। সাথে সাথে এসে তখনও আগুন দেখতে পান। তখনো তার দোকান পর্যন্ত আগুন যায়নি। তিনি ভেতরে ঢুকতে অনেক চেষ্টা করলে কেউ তাকে ঢুকতে দেননি। তিনি বলেন, আমার দুটি দোকান ছিল। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। দুটি দোকান মিলে আমার ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সব জিনিসই দেশের বাইর থেকে আনা। এর আগেও তার তিনটি দোকান পুড়ে দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলেও জানান নাঈম। শাকিল আহমদ, তিনি সামিয়া ভেবারিজ স্টোরের মালিক। ক্রোকারিজ জিনিপত্র বিক্রি করতেন। এবার আগুন লেগে ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। এর আগে আগুন লেগে ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। আরেকজন দোকান মালিক হারিছ উদ্দিন। তিনি বলেন, আপনাদেরকে বলে কী লাভ হবে, কই কোনো লাভ নেই- এ কথা বলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তিনি চলে যান। শরীয়তপুর ট্রেডার্সের মালিক আবুল কালাম। ১৬ নাম্বার দোকানটি ছিল তার। এবার তার ৩২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে, আগেরবার আগুনে ৪০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছিল বলেও জানান তিনি। বিল্লাল ক্রোকারিজের মালিক বিল্লাল হোসেন, ১১৪, ১১২, ১১০ নাম্বার দোকানগুলো ছিল তার। ১৭ সালের আগুনে ক্ষতি হয় দেড় কোটি টাকা, এবারের আগুনে ৮০ লাখ!