Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

যেনো সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ!

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ১, ২০১৯, ০৫:৪৫ এএম


যেনো সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ!

গোটা বিশ্বের উন্নত সব দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। হাঁটি হাঁটি পা পা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তিও সঞ্চয় করেছে অনেকটা। অথচ উন্নয়নের মহাসড়কের এতটা পথ পাড়ি দেয়ার পরও সড়কের নৈরাজ্য আর অগ্নিতাণ্ডব যেন পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে পেছনে টেনে ধরেছে এবং জাতির কাছে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু তাই নয়, সরকার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব মহলই যেন আজ দায়িত্ব পালনে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। গোটা দেশের মানুষই আজ উন্নয়নের সমালোচনায় ব্যস্ত। সবার মনে একটিই জিজ্ঞাসা- জীবিকার প্রয়োজনে কিংবা কাজে বাসা থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ফিরতে পারব তো? এই আতঙ্কের যথাযথ কারণও রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মতোই অগ্নি দুর্ঘটনাও এখন ভয়ালমূর্তি ধারণ করেছে। সড়ক-মহাসড়কে পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীতে হরহামেশাই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব ঘটনায় কোনোটির ব্যাপকতা ছোট আবার কোনোটির ব্যাপকতা বড়। তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে সবখানেই। কেউ কেউ বলছেন, এ উন্নয়নের পাশাপাশি যদি জীবনের নিরাপত্তাই না থাকে তবে তাতে লাভ কি? যে জীবন পুড়ে যাওয়ার, গাড়িচাপা পড়ার, উন্নয়নের ফল ভোগ করার আগেই অপঘাতে ফুরিয়ে যাওয়ার, সে জীবনের মূল্য কোথায়? ভবনে গিয়ে যদি পুড়ে মরতে হয়, মহাসড়কে গিয়ে যদি দুর্ঘটনার শিকারই হতে হয়, তবে এই উন্নয়নে লাভ কি? অভিশপ্ত এই উন্নয়ন থেকে মেঠোপথ আর কুঁড়েঘরই ভালো ছিল- দেশের আপামর জনতার এমন বক্তব্যই উঠে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। উন্নয়নের মহাসড়কে আজ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনা আর অগ্নিকাণ্ড। তার মধ্যে গত মাসে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্য একটি। যে ঘটনায় প্রাণ হারান ৭২ জন। এই শোক কাটতে না কাটতেই গত বৃহস্পতিবার আগুন লাগে বনানীর এফআর টাওয়ারে। এতে প্রাণ যায় ২৬ জনের। এরপর শুক্রবার গভীর রাতে আগুন লাগে ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গুলশান-১ নম্বরের কাঁচাবাজারে। এতে কেউ প্রাণ না হারালেও সহায়-সম্বল হারিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। কোনো কোনো হিসাবে উঠে এসেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়াও বিগত কয়েকদিনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, এসি বিস্ফোরণ এবং গ্যাসের চুলা থেকে লাগা আগুনে মারা যায় অসংখ্য মানুষ। আহতও হয়েছে অনেক। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে সারাদেশে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডে ১ হাজার ৫৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। চূড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন নিহত হওয়ার সপ্তাহখানেক ব্যবধানে মিরপুর ১৪ নম্বরের ভাসানটেক বস্তিতে আগুনে ১৫০ ঘর ভস্মীভূত হয়ে যায়। এছাড়া রাজধানীর লালবাগে চুড়ির কারখানায়, রামপুরার চারতলা ভবনে, মহাখালীর কড়াইল বস্তিসহ বেশকিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ এফআর টাওয়ারে ২৬ জনের মৃত্যু হয়।অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী ভবন নির্মাণ না করা এবং ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা। ফলে ছোটখাটো স্পার্ক বা সিগারেটের ধোঁয়া কিংবা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট যে কারণেই শুরু হোক না কেন পরর্বতী সময়ে তা বড় আকার ধারণ করে। অতীত উদাহরণও তাই বলছে। গত ১০ বছরে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই ছোট কারণে শুরু হলেও পরর্বতীতে বড় আকার ধারণ করে। ভবনের নির্মাণ ত্রুটিসহ পর্যাপ্ত প্রাথমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং রাস্তায় জ্যামের কারণেও যথাসময়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না।এদিকে, সড়কে মৃত্যুর অন্যতম কারণ পরিবহন খাতের নৈরাজ্য। সড়কে প্রাণ হারানোর ঘটনায় দেশব্যাপী আন্দোলনের সৃষ্টি হলেও সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে সড়ক ইস্যুতে সরকারের নীরবতা অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই। সর্বশেষ রাজধানীর প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিইউপির ছাত্র আবরারকে পিষে মারার ঘটনায় সাময়িক আশ্বাস দিয়ে সৃষ্ট আন্দোলন স্থগিত করার পর ফের গত শনিবার নোয়াখালীতে বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মা-মেয়েসহ চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। ওই এক সপ্তাহে চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় রিলাক্স বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে ঝরেছে অন্তত ৬০টি প্রাণ। এতে জনজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। এত মৃত্যু হলেও নিরাপদ সড়ক যেমন নিশ্চিত হয়নি তেমনি চকবাজারের ঘটনার পরও ভবনের নিরাপত্তায় প্রশাসনের তৎপরতাও তেমন পাওয়া যায়নি।সমাজতত্ত্ববিদ ড. মিযানুর রহমান শেলী বলেন, নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সরকারের দায়িত্বহীনতায় যদি সড়ক আর ভবনে সাধারণ নাগরিকরা নিরাপদবোধ না করেন, অস্বস্তিতে থাকেন তবে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ বিনির্মাণে এর প্রভাব পড়বে।আইনজীবী মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, অগ্নিকাণ্ড আর সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে এ ধরনের সঠিক তথ্য নেই। যার কারণে সাধারণ মানুষ নিরপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভুগছে। এক-একটি ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি তৈরি হয়। সেই তদন্ত কমিটির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানা যায় না।রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, দেশের বাসাবাড়ি, সুউচ্চ ভবন, রাজপথ, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু সব যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ। লাশের গন্ধে চারদিক ভারী হয়ে উঠছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। শবযাত্রায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন লাশ।