Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

৩ মাসেই উন্নয়নের নৌকা বিষময়!

প্রিন্ট সংস্করণ॥আসাদুজ্জামান আজম

এপ্রিল ১, ২০১৯, ০৬:১৬ পিএম


৩ মাসেই উন্নয়নের নৌকা বিষময়!

গ্রামের এক প্রান্তে এক বটগাছ ছিল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিক বটগাছের শীতল ছায়ায় তার শরীর জুড়াত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতো। আর অকৃতজ্ঞ পথিক যাওয়ার সময় বটগাছের পাতা-ডাল ভেঙে দিয়ে যেত, কিংবা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বটগাছের কষ বের করত। মানুষ উদাসীনতার অকৃতজ্ঞতা কত নির্মম, একসময়ে পাঠ্যবইয়ে থাকা গল্পটি তার উদহারণ। বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি এখন রাজনৈতিক মাঠে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেতে কতই না চেস্টা তদবির করেছেন সাংসদরা। নির্বাচনে নৌকাকে কতই বিশ্লেষণে ভোটারসহ দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। নৌকা প্রতীককে স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তিযুদ্বের প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক গণতন্ত্রের প্রতীক বলে প্রচারণা চালিয়েছেন দিন-রাত। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সে নৌকা প্রতীক বিষাক্ত হয়ে গেছে ওই সাংসদেরই কাছে। শুনতে বেখাপ্পা লাগলেও চলমান উপজেলা নির্বাচনে এমনটাই ঘটেছে। অন্তত শতাধিক উপজেলায় নৌকার প্রতীকের বিরুদ্ধে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় সাংসদরা। ওইসব সাংসদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্যও। নৌকার প্রতিপক্ষ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় সাংসদ ও পরিবারের সদস্যরা। নির্বাচনে ওই উপজেলায় এমপি বলয়ের আ.লীগ আর তৃণমূল আ.লীগ মুখোমুখি হয়ে উঠে। আর এ মধ্যে অধিকাংশ উপজেলায় ভরাডুবি হয়েছে নৌকার।তথ্য মতে, স্থানীয় রাজনীতির ত্রাণকর্তা ওই আসনের সাংসদ। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড সব কমিটিতে তার একক কর্তৃত্ব। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ সব নির্বাচনেই সাংসদ পন্থিরাই মনোনয়ন ও নির্বাচিত হন। যারা এমপির মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন, অনিশ্চয়তায় পড়ে তাদের রাজনীতি। দল বা সরকারি কর্মকাণ্ডে কোথাও তাদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। দলসহ সরকারের সুযোগ-সুবিধার সুফল পেয়ে থাকে এমপির পছন্দনীয় লোকজন। তৃণমূলের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিগত কয়েকটি প্রার্থী নির্বাচনে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিকে প্রার্থী চূড়ান্ত করে আসছে কেন্দ্র। কিন্তু তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা প্রণয়নে মূল ক্রীড়নক সাংসদই। তারা যাকে প্রার্থী করেন, তার নামই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সাংসদের কড়াকড়ি নজরদারি ভেদ করেই সরাসরি কেন্দ্র থেকে আ.লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন অনেক তৃণমূল নেতা। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন সাংসদ ও অনুসারীরা। যার কারণে ক্ষুব্ধ সাংসদ নৌকা প্রতীকের ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। একাধিক উপজেলায় নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছে স্থানীয় সাংসদের পরিবারের সদস্যরা। আর ওইসব উপজেলায় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে নৌকার মনোনিত প্রার্থীরা। শুধু বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানো নয়, নৌকার প্রার্থী ও তার পক্ষে থাকা নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। সূত্র মতে, বিএনপিসহ সরকার বিরোধী দলবিহীন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আ.লীগ। যার কারণে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানো হয়। কিন্তু তার মানে এই নয়, নৌকা প্রতীকের সাংসদরাও নৌকা বিরোধিতা করবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অনেক সাংসদ এমনটাই করেছেন। যাকে অনেকটা আত্মঘাতী বলে দেখছেন দলটির হাইকমান্ড। গত ২৯ মার্চ দলের প্রেসিডিয়াম সভায় ওইসব সাংসদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিলেন বা নিচ্ছেন, তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকের বাইরে যারা নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কেউ তাদের সহযোগিতা করেছে কি না এবং কারা সহযোগিতা করেছে তাদের তালিকা করার জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে দলের বিদ্রোহী এবং বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ধাপের নির্বাচনের নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলায় নৌকার প্রার্থী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর আ.লীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। দলীয় প্রার্থী মনমতো না হওয়ায় বিকল্প প্রার্থী হিসেবে জেলা আ.লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দেন স্থানীয় সাংসদ আবদুল কুদ্দুস। তিনি নিজে এবং নেতাকর্মীরা আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েন নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে। নির্বাচনের ফলাফল সহজ জয় পান সাংসদ আবদুল কুদ্দুসের সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন। জেলাটির বাগাতিপাড়া উপজেলায় নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার রহমান। সাংসদ ভাই শহীদুল ইসলামের দাপট খাটিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন বিদ্রোহী প্রার্থী অহিদুল ইসলাম (গকুল)। লালপুরে উপজেলায়ও নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হন সাংসদ শহীদুল ইসলামের আপন ভগ্নিপতি ইসাহাক আলী। সিংড়া উপজেলায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান ও পৌর আ.লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম। বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে নামেন নব্য আ.লীগ খ্যাত আদেশ আলী সরদার। তিনি উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। স্থানীয় সাংসদ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ওই নির্বাচনে উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবিব এবং পরিচিত সিংড়া পৌরসভার মেয়র ও পৌর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস সরাসরি নৌকার বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নেন। তাদের দাপটে ভোটের দিন বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেননি শফিকুল। কিন্তু অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে জয় পান তিনি। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক জয়ী হয়েছে ৫২টি উপজেলায়। স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৩৫টি উপজেলায়। দ্বিতীয় ধাপে ফরিদপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় জয় পায় আ.বিদ্রোহী প্রার্থী। সিলেটের ১২ উপজেলার মধ্যে সাতটিতে আ.লীগ ও পাঁচটিতে দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন। মৌলভীবাজারের সাতটি উপজেলার মধ্যে চারটিতে আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয় পান। রাজশাহী বিভাগের ১০ উপজেলায় বিভাগের বিজয়ী হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বগুড়া জেলায় তিনটি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। গাইবান্ধায় দুটিতে এবং নওগাঁ জেলায় একটিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থী। রাঙ্গামাটিতে তিনটি এবং কক্সবাজারে দুটি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র। দিনাজপুর জেলার চার উপজেলায় জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র ও একটি জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছেন। তৃতীয় ধাপে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় আ.লীগ মনোনিত নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আ.লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম। বিদ্রোহী প্রার্থী হন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাংসদ আলী আজগার টগরের আপন ছোটভাই দর্শনা পৌর আ.লীগের দপ্তর সম্পাদক আলী মনসুর বাবু। তিনি সাংসদ ভাইয়ের দাপটে গোঠা নির্বাচনি এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ নেন। সাংসদ আলী আজগার টগরও নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন বলে জানান সিরাজুল আলম। আর এ কারণে জয় পান আলী মনসুর বাবু। চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় গত ৩১ মার্চ। ওই নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলা নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন জহির উদ্দিন সিদ্দিক টিটু। কিন্তু ওই প্রার্থী সাংসদের মনমতো না হওয়ায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মোহম্মদ মনিরুজ্জামানকে নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামেন সাংসদ এবাদুল করিম বুলবুল ও তার অনুসারীরা। ভোটের ফলাফলে নৌকার প্রার্থীর পরাজয় হয়। ময়মনসিংহ জেলার ভোট অনুষ্ঠিত হওয়া সাত উপজেলার মধ্যে তিনটিতে আ.লীগ, তিনটিতে আ.লীগের বিদ্রোহী ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন।