Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া!

প্রিন্ট সংস্করণ॥মো. হাসান আরিফ

এপ্রিল ২, ২০১৯, ০৬:০৪ পিএম


হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া!

হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল জি বাংলা, জি সিনেমা ও জি টিভি বন্ধ করে দিয়েছে কেবল অপারেটররা। সরকারের ওপর চাপ দিতে দেশীয় ৩০টি চ্যানেল ছাড়া সব চ্যানেল বন্ধ করার ইঙ্গিতও দিচ্ছেন তারা। তবে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ডাউন লিংক করে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখানো দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশীয় চ্যানেলের স্বার্থরক্ষায় কোনোভাবেই আইনের ব্যত্যয় করা হবে না।সরকার কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়াতে ক্যাবল অপারেটররা গত সোমবার দুপুর থেকে বাংলাদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠান জি নেটওয়ার্কের সব চ্যানেলের সমপ্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া ভারতের আরেকটি বড় নেটওয়ার্ক স্টারসহ আরও বিদেশি চ্যানেলের সমপ্রচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশে বিদেশি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ায় সরকাররের ওপর চাপ দিতে এই পন্থা নিয়েছে ক্যাবল অপারেটররা।ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সভাপতি এসএম আনোয়ার পারভেজ বলেন, বাংলাদেশি ৩০টি চ্যানেল ছাড়া অন্য চ্যানেলও বন্ধ হয়ে যাবে, আপাতত তাই মনে হচ্ছে। জি নেটওয়ার্কের পর স্টার নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যাবে।ক্যাবল অপারেটর সূত্রে জানা গেছে, শুধু ভারতের জি নেটওয়ার্কের(জি বাংলা, জি সিনেমা, জি টিভি) চ্যানেলগুলোই নয়, পর্যায়ক্রমে দেশে সমপ্রচার হওয়া আরও বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করা হবে! শুধু দেশের ৩০টি চ্যানেল ছাড়া বিদেশের কোনো চ্যানেল আর দেখা যাবে না।এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি। সরকার প্রচলিত আইন প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশের ‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬’ এর উপধারা-১৯(১৩) এর বিধান মতে বাংলাদেশে বিদেশি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যায় না। শুধু দেশীয় বিজ্ঞাপন নয়, কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো যায় না। এ বিষয়েই তাদের নোটিস দেয়া হয়েছে।জানা গেছে, গত সোমবার বাংলাদেশে জি নেটওয়ার্কের সবকটি চ্যানেলের সমপ্রচার বন্ধ হওয়ার আগে একই দিনে ক্যাবল অপারেটরদের একটি চিঠি পাঠিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন সমপ্রচারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। জানতে চাওয়া হয়, কোন কোন বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর মধ্যে টিভি বিভাগের দায়িত্বে থাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুর রাজ্জাক বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চ্যানেলগুলো বন্ধ করতে বলা হয়নি। এসব চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন সমপ্রচার হচ্ছে কিনা, ক্যাবল অপারেটরদের তা জানাতে বলা হয়েছে। বিষয়টি সাতদিনের মধ্যে জানাতে ক্যাবল অপারেটরদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।ক্যাবল অপারেটরদের সংগঠন ও অপারেটরদের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, জি নেটওয়ার্কের পাশাপাশি শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে ভারতের আরেকটি বড় নেটওয়ার্ক স্টারসহ আরও বিদেশি চ্যানেলের সমপ্রচার কার্যক্রম।ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সভাপতি এসএম আনোয়ার পারভেজ জানান, বাংলাদেশি ৩০টি চ্যানেল ছাড়া অন্য চ্যানেলও বন্ধ হয়ে যাবে, আপাতত তাই মনে হচ্ছে। জি নেটওয়ার্কের পর স্টার নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এ বিষয়ে এখনই তার কোনো মন্তব্য নেই। কেন এমনটা হচ্ছে? তাও বলতে নারাজ কোয়াবের সভাপতি। তবে তিনি বলেছেন, বিদেশি চ্যানেল বন্ধ হওয়া মানে তাদের অপারেটিং সিস্টেমও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, শুধু দেশের চ্যানেলের জন্য দর্শক তাদের ফি দেবে না। আবার এটা আসলে সমাধানের পথ নয় বলেও তিনি বলেন। মাথা ব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়।এদিকে, ক্যাবল অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘জাদু ডিজিটালের’ কাস্টমার সার্ভিস কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ গতকাল একাধিক গণমাধ্যমকে জানান, তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে বাংলাদেশে জি নেটওয়ার্কের চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশি চ্যানেলগুলোতে অবাধে সমপ্রচার হচ্ছে দেশীয় বিজ্ঞাপন।এদিকে বাংলাদেশে বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের সমপ্রচার বন্ধ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বলেছেন, কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬’ এর উপধারা-১৯(১৩) এর বিধান লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে ডাউনলিংককৃত বিদেশি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে গত সোমবার পরিবেশক সংস্থা ন্যাশনওয়াইড মিডিয়া লিমিটেড এবং জাদু ভিশন লিমিটেডকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। নোটিস দেয়ার পর রাত থেকে ভারতের জি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে প্রদর্শিত হচ্ছে না। একই ধরনের আইন ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সে সব দেশে এ আইন মানা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যারা টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক তারা জানেন, আপনাদের টেলিভিশন চ্যানেল যখন ইউকে প্রদর্শন করা হয় তখন এখানে যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখান, সেগুলো সেখানে দেখানো যায় না। সেখানে সেই দেশের বিজ্ঞাপন দেখানো যায়। ভারতে এবং অন্যান্য দেশে যখন টেলিভিশন চ্যানেল যখন প্রদর্শিত হয় তখন সেখানে বিদেশের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয় না। কন্টিনেন্টাল ইউরোপেও একই রকম।তথ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এ আইনটি মানা হচ্ছিলো না। আইনটি প্রয়োগ করা হয়নি। সেটি না করার কারণে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যে বিজ্ঞাপন পেতো সেগুলো চলে গেছে ভারতে। পরিসংখ্যান দিয়ে মন্ত্রী জানান, ইউনিলিভার বাংলাদেশে পাঁচ বছর আগে বিজ্ঞাপন খাতে বাংলাদেশে ১৫ কোটি টাকা খরচ করতো। যেটি পাঁচ বছর পরে ২০ কোটি হওয়ার কথা ছিল, সেটি কমে পাঁচ কোটিতে গেছে। বাকি বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রদর্শন করা হচ্ছিল, যেটি আইন বহির্ভূত। এরকম আরও অনেক কোম্পানি বছরে ৫০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন অন্য দেশে চলে গেছে। টাকাটাও চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য আমরা আইনটি প্রয়োগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করছি। আইন প্রয়োগ করার আগে দুই মাস ধরে প্রচারণা করেছি। টেলিভিশন চ্যানেলের পক্ষ থেকে দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা তিন দফা নোটিস দিয়েছি। এরপরও যখন দেখানো হচ্ছে, ১ তারিখে আমরা দেখতে পেলাম যে ডাউনলিংক করে বিদেশি চ্যানেল দেখায় সেখানে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। তখন আমরা আইন মোতাবেক নোটিস দিয়েছি। সাতদিনের মধ্যে তাদেরকে কারণ দর্শাতে বলেছি, তারা নোটিসের জবাব দিক। জবাব দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা কোনো চ্যানেল বন্ধ করিনি।তথ্যমন্ত্রী সংস্থা দুটিকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, তারা সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলোর কাছে ক্লিন ফিড চাইতে পারে অথবা তারা যন্ত্র স্থাপন করে ক্লিন করে প্রদর্শন করতে পারে।চ্যানেল দুটি (জি-বাংলা, জি-সিনেমা) দেখা যাচ্ছে না কেন- প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, সেটা তারাই বলতে পারবে। আমরা বলেছি বিজ্ঞাপন ছাড়া যেন দেখানো হয় এবং বিজ্ঞাপনসহ দেখানো হচ্ছে, আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে কতটা কঠোর থাকবে- প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই। আমরা নতুন কোনো আইন প্রয়োগ করছি না। দেশের স্বার্থে, দেশের গণমাধ্যম এবং টেলিভিশনের স্বার্থে এবং টেলিভিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক-কলাকুশলীর স্বার্থে প্রচলিত আইন প্রয়োগ করা শুরু করেছি। তিনি বলেন, আপনারাই বলেছেন, অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে বেতন দেয়া হচ্ছে না। তিন মাস ধরে বেতন দেয়া হয় না। হঠাৎ করে ছাঁটাই করে দেয়া হয়। তখন আমরা যখন টেলিভিশন মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা বলেছে আমাদের পরিচালনা ব্যয় বেড়ে গেছে। বিজ্ঞাপন ছাড়া টেলিভিশনের কোনো আয় নেই। বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন অব্যাহত থাকলে আয় কমে যাবে। এক্ষেত্রে আপনারা সঙ্গে থাকলে, দেশের স্বার্থের সঙ্গে থাকলে আমরা এই আইন অবশ্যই প্রয়োগ করবো। বাংলাদেশে বিদেশি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো লোকসানে পড়ছে জানিয়ে ওইসব চ্যানেলে দেশি বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি করে আসছিল দেশের টিভি চ্যানেলের মালিকরা। এর আগে বাংলাদেশে তিনটি ভারতীয় টিভি চ্যানেল স্টার প্লাস, স্টার জলসা ও জি বাংলা বন্ধ করতে রিট আবেদন করা হলে তা খারিজ করে দিয়েছিল হাইকোর্ট। ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিটটি করেছিল। একই বছরের ১৯ অক্টোবর রিট আবেদনের শুনানি শেষে ভারতীয় এই তিন টিভি চ্যানেল বন্ধে নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট।