Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

গণফোরামের ইতিহাস মোকাব্বির!

প্রিন্ট সংস্করণ॥আবদুর রহিম

এপ্রিল ২, ২০১৯, ০৬:২৫ পিএম


গণফোরামের ইতিহাস মোকাব্বির!

গণফোরাম প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পর এই প্রথমবারের মতো গণফোরামের কোনো প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শপথ নিলেন। ড. কামাল হোসেন দীর্ঘ এত বছর চেষ্টা করেও কাউকে সংসদ সদস্য বানাতে পারেননি। অবশেষে বিএনপিসহ একজোট হয়ে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে মোকাব্বিরের মাধ্যমে ইতিহাস গড়লেন ড. কামাল। এর পরপরই ঐক্যফ্রন্টের বড় একটি অংশ থেকে প্রশ্ন উঠেছে ড. কামালের নেতৃত্ব মানেন না সুলতান মনছুর, মোকাব্বির হোসেন। তাহলে জনগণ কেন মানবে? ড. কামালের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরাই এক এক করে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যিনি বছরের পর বছর তার অনুসারীদের ঐক্যর শিক্ষা দিয়েও ঐক্যে রাখতে পারছেন না। তাহলে সেই ঐক্য জাতির কোন উপকারে আসবে? বিএনপির কি লাভ হবে— এমন সমালোচনা করে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলছেন। বিএনপির ভাষ্য— তাহসিনা রুশদীর লুনার প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর রাগ করে যুক্তরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন মোকাব্বির। কিন্তু ঘটনাক্রমে ফের ভাগ্য ফেরে এই গণফোরাম নেতার। তখন তাহসিনা রুশদীর লুনার নির্দেশে নিখোঁজ এম ইলিয়াছ আলীর ছোট ভাই এম আছকির আলী ও ইলিয়াসপুত্র অর্নব অংশ নেন মোকাব্বিরের প্রচারণায়। সেই মোকাব্বির কী এখন বিএনপির সাথেও বেইমানি করলো— প্রশ্ন বিএনপির। অবশেষে মোকাব্বির কী ইলিয়াছ পরিবারের সহযোগিতা স্বীকার করবে? এমন শঙ্কার কথাও জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। জানা যায়, আলোচিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ (বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর) আসনে দলীয় প্রতীক (উদীয়মান সূর্য) নিয়ে জয়ী হন গণফোরামের মোকাব্বির খান। দল ও জোটের আপত্তির মুখেও আলোচিত- সমালোচিত এই সংসদ সদস্য শপথ নিয়েছেন গতকাল। শপথ নেয়ার মাধ্যমে নিজ দল, জনগণ ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা মোকাব্বির খানকে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেও সিলেট-২ আসনের বেশিরভাগ ভোটার চিনতো না, সামনাসামনি দেখেওনি। এ আসনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জামা দেন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা ও তার পুত্র ইলিয়াস আবরার অর্নব। ইসিতে মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে তাহসিনা রুশদীর লুনার মনোনয়নপত্র বৈধতা পায়। ফলে ইলিয়াসপুত্র অর্নব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলে ধানের শীষের চূড়ান্ত প্রার্থী হয়ে নির্বাচনি মাঠে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন তাহসিনা রুশদীর লুনা এবং প্রতীক বরাদ্দের দিন লুনাকে সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাজ্য চলে যান গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান। লুনার মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর লুনার প্রার্থিতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে বসেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সমর্থিত জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহহিয়া চৌধুরী। লুনার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেয়া সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন হাইকোর্ট। লুনার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় প্রার্থী সংকটে পড়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। পরে ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান। নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে তাকে ২৩ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানায় বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলার বিএনপি-জামায়াত। ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তা ও আধিপত্যে আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বনে যায়। আর নিখোঁজ হওয়ার পর এ আসনের মানুষের মধ্যে আলাদা এক সহানুভূতি তৈরি হয় ইলিয়াসকে ঘিরে। তাই উপজেলা, পৌরসভাসহ প্রায় সব নির্বাচনে ইলিয়াস পরিবারের সমর্থন থাকলেই কপাল খোলে সেই প্রার্থীর।অসুস্থ তাহসিনা রুশদীর লুনার নির্দেশে নিখোঁজ এম ইলিয়াছ আলীর ছোট ভাই এম আছকির আলী ও ইলিয়াসপুত্র অর্নব অংশ নেন মোকাব্বিরের প্রচারণায়। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আবেগময়ী বক্তব্য দেয়ায় ভোটার সাধারণের মাঝে বিপুল সাড়া জাগে। পাশাপাশি ইলিয়াস আলীর প্রতি এই আসনের ভোটারা বেশ আবেগপ্রবণ হওয়ায় ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের স্থলে ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীক চলে আসে মূল আলোচনায়। আর এতেই খুলে যায় মোকাব্বিরের ভাগ্য।যদিও নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে নতুন নির্বাচনের দাবি তোলা বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ভোটে বিজয়ীদের শপথ না নেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই শপথ নেন ড. কামালের অনুসারী সুলতান মনসুর। তার শপথ নেয়ার সমালোচনা করে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাগো লগে থাইকা, আমাদের এখান থেকে আমরা পাখি ছাইড়া দিলাম, সংসদে চইলা গেল। আরও কিছু অপেক্ষা (সংসদে যোগদান) করছে কিনা, আরও কিছু যাবে কিনা তাও জানি না।’ গয়েশ্বর এ সংশয় প্রকাশের দুই সপ্তাহ না যেতেই শপথ নিলেন মোকাব্বির খান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমি শপথ নেয়ার যে চিঠি দিয়েছি তা দলের সিদ্ধান্তে দেয়া হয়েছে। এটা আমার দলের সিদ্ধান্ত। তবে তা অস্বীকার করে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, দলের সিদ্ধান্ত আগে যেটি ছিল সেটিই আছে। উনি যদি দলের কথা বলে থাকেন তাহলে তা সঠিক নয়। আর গণফোরামের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, সাধারণ সম্পাদকের অনুমোদন ছাড়া কেউ দলীয় প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না। উনি যদি দলীয় প্যাডে চিঠি দিয়ে থাকেন তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ।গণফোরামের প্যাড চুরিসংক্রান্ত নির্বাহী সভাপতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে মোকাব্বির খান শপথ নিয়ে বলেন, ‘এটা সত্য নয়। আমি দলের সিদ্ধান্ত নিয়েই শপথ নিয়েছি। যিনি এসব কথা বলছেন, হয়তো তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। ব্যক্তিগত ক্ষোভ, চাওয়া-পাওয়ার হতাশার জায়গা থেকেই তিনি হয়তো এসব বলেছেন। আমি তার সুস্থতা কামনা করি।’ তার এই শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মোকাব্বির বলেন, ‘আমি তো বিএনপির হয়ে নির্বাচন করিনি। গণফোরামের ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন করেছি। অতএব ঐক্যেও কোনো সমস্যা হবে না।’ তিনি তার নিজ নির্বাচনি এলাকার জনগণ ও নিজ দল গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘২৬ বছর আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি। গণতন্ত্রের সংগ্রাম, আদর্শের সংগ্রাম, মূল্যবোধের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর যে নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ নিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেটা রক্ষা করে গণফোরাম থেকে আমি নির্বাচিত হয়েছি।’মোকাব্বিরের শপথ গ্রহণ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ব্রেকিং নিউজকে বলেন, ‘সুলতান মনছুরের পথ অনুসরণ করে জনগণ ও জাতির সঙ্গে মোকাব্বিরও প্রতারণা করেছেন।’ তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে মোকাব্বিরের শপথ গ্রহণকে ‘সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন গণফোরামের আরেক সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনছুর আহমেদ।এদিকে সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের সভায় যোগ দেয়ায় বিএনপির ৯ নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে শোকজের সন্তোষজনক জবাব না পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট বিএনপির নেতারা। গতকাল মঙ্গলবার তাদের শোকজের চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ।শোকজপ্রাপ্তরা হলেন— বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি রইছ উদ্দিন মাস্টার, সহসভাপতি তাহিদ মিয়া, যুগ্ম সম্পাদক নাজমুল ইসলাম রুহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক কবির হোসেন ধলা মিয়া, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মন্নান রিপন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এটিএম নুর উদ্দিন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নুর, গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক আবুল হোসেন ও জেলা বিএনপির সদস্য জসিম উদ্দিন জুনেদ। ওই সভায় বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা আবদাল মিয়া ও সুহেল আহমদ চৌধুরীও ছিলেন। আবদাল মিয়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ছিলেন, সুহেল ছিলেন সহসভাপতি। গেলো উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় তাদের বহিষ্কার করা হয়।বিএনপিনেতা আলী আহমদ জানান, শোকজকৃতদের এক সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। জবাব সন্তোষজনক না হলে কিংবা কেউ জবাব না দিলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, ওই ৯ নেতা মোকাব্বির খানের সভায় যোগদান করায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সভাপতি জালাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক লিলু মিয়া জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনুরোধ করেন। প্রসঙ্গত, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান গতকাল মঙ্গলবার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। এর আগে গত রোববার তিনি নির্বাচনি এলাকা বিশ্বনাথে নাগরিক সভা করেন। ওই সভায় যোগ দেন বিএনপির ওই নেতারা।