প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু
এপ্রিল ২, ২০১৯, ০৬:২৭ পিএম
গত চারশ বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাংশে দুটি ভূ-গাঠনিক প্লেটে শক্তি সঞ্চয়ের ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান বাংলাদেশ- এমনটাই শঙ্কা করছেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে এবং এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে দেশের রাজধানীসহ সিলেট ও চট্টগ্রাম শহর। নেচার জিও সায়েন্স জার্নালে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের একদল গবেষক সম্প্রতি এমনই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই বিজ্ঞান সাময়িকীতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে ভূ-গাঠনিক প্লেটে শক্তি সঞ্চয়ের ফলাফল হলো ভূমিকম্প। ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা- এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ ভয়ঙ্করভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক হুয়ায়ূন আখতার বলেন, পূর্ব-পশ্চিমে আড়াইশ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত রয়েছে। আমাদের মডেলে আমরা দেখেছি ৮.২ থেকে ৯ মাত্রা ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি সঞ্চিত রয়েছে সেখানে। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দুটি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্টলাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দুটি চলন্ত প্লেটের ফল্টলাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্টলাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলেই ভূমিকম্প শুরু হয়। বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মাঝামাঝিতে। বুয়েটের গবেষকদের ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১ শতাংশ এলাকা মধ্যম (জোন-২) ও ১৬ শতাংশ এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে।জোন-১-এ রয়েছে পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশ বিশেষ। রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও ঢাকা রয়েছে জোন-২-এর অধীনে। জোন-৩-এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। এমনকি ভারতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর বাংলাদেশেও কিছুদিন পর ভূমিকম্প হয়েছে। নেচার জিও সায়েন্স জার্নালে বলা হয়, প্রায় ১৬ কোটির বেশি মানুষের এ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং তা বাড়ছে দ্রুততার সঙ্গে। দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম নদী অববাহিকা এবং তা সমুদ্র উচ্চতার কাছাকাছি। এর ফলে বাংলাদেশ সুনামি হুমকিতেও রয়েছে। ভূমিকম্প হলে নদীগুলোর তীর লাফিয়ে লাফিয়ে গতিপথের পরিবর্তন ঘটাবে। বড় বড় ব্রিজ ও বহুতল ভবনগুলো ধসে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দেশের বাইরে কাছাকাছি ও দেশের ভেতরে ভূমিকম্পের উৎস থাকায় যে কোনো সময় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের ঢাকা একটি অপরিকল্পিত ও জনবহুল নগরী। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎস থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হতে পারে।এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের পর ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশীয় বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়ে সরকারকে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়ে নির্মাণ বিধি ও নিরাপত্তাজনিত অন্যান্য বিষয়গুলো অবহেলা করে নির্মিত সুউচ্চ ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান। এ ঝুঁকিতে রাজধানীতে প্রাণহানির শঙ্কায় রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই রাজধানী শহরে ভয়াবহ ভুমিকম্পের আশঙ্কা মোকাবিলায় আগে থেকেই সরকারকে এ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন কমিটি করার। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্মাণবিধি না মানায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের আশঙ্কা করে সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ঢাকার অধিকাংশ ভবন নির্মাণ বিধি ও ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ আইন অমান্য করে তৈরি হয়েছে। যার ফলে গোটা রাজধানী রয়েছে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। আগে থেকেই এর পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট না হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে এতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে যে, শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পের আঘাতে এক লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এরপরও ভূমিকম্পের প্রস্তুতিতে দেশে তেমন অগ্রগতি হয়নি। রাজধানীর ৮০ শতাংশ ভবন রাজউকের অনুমোদন ছাড়া হয়েছে উল্লেখ করে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, অন্য ভবনগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ ভবন নকশার বরখেলাপ ও নিয়ম লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই অধিকাংশ ভবন তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তাই পুরো ঢাকা শহর ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশিরভাগ ভবন ও স্থাপনাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ছাড়াই নির্মিত হয়েছে।