Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

বাড়ছে ভোটারদের অনাস্থা

প্রিন্ট সংস্করণ॥রফিকুল ইসলাম

এপ্রিল ৩, ২০১৯, ০৫:১৭ এএম


বাড়ছে ভোটারদের অনাস্থা

একটি গণতন্ত্র রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি রচিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনে প্রতিটি নাগরিক তার ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভোট প্রয়োগে অনাস্থা দেখা দিয়েছে। ভোটদাতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ থাকছে না প্রায়ই। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। শুধু জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়, একই অবস্থা দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো নির্বাচনের। তবে যেসব কারণে ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ, সেসব কারণ খুঁজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।গত ১০ মার্চ থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন মোট পাঁচটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় নির্বাচনের পর দেশে ভোটের রাজনীতিতে এটি দ্বিতীয় ও বৃহৎ নির্বাচন। অথচ পঞ্চম উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের প্রথম চার ধাপই নিরুত্তাপ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন নিয়েও ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি বিএনপি-জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টনেতারা আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক জোটের এমন সিদ্ধান্তের পর ভোটের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা নির্বাচন। প্রথম চার ধাপের ফলাফলে দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হয়। শুধু চেয়ারম্যান নয়, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন মোট ৮৮ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৯, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২২ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৭ জন। এর আগে প্রথম ধাপে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ২৮ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৬ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ৭ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ধাপে ২৩ জন চেয়ারম্যান, ১৩ ভাইস চেয়ারম্যান ও ১২ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তৃতীয় ধাপে ২১ জন প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হন।একই অবস্থা ছিলো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচন। ওই নির্বাচনেও ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোট পড়েছিলো ৩১.০৫ শতাংশ। যা সংখ্যায় ৯ লাখ ২৩ হাজার ২৬ ভোট। ডিএনসিসির এ নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের মো. আতিকুল ইসলাম। এই ভোটের আট ভাগের এক ভাগ এককভাবে না পাওয়ায় জামানত হারিয়ে ছিলেন মো. শাফিন আহমেদ, মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান, মো. আব্দুর রহিম ও শাহীন খান। এ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। একই রকম অবস্থা ছিল ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা তখন কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মেয়র (অবিভক্ত ঢাকার) নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ। এদিকে দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। বহু অপেক্ষার পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হল সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩৪টি পদের মধ্যে ৫৬টিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় প্রার্থীরা। অথচ গত ৩০ ডিসেম্বর দেশে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে বিশেষ আগ্রহ ছিলো। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় আলাদা আগ্রহ ছিলো একাদশ নির্বাচনকে ঘিরে। ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে টানা তৃতীয় মেয়েদে সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলসহ বিএনপির সময় বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিতর্কিত পদ্ধতিতে। সেই সময়গুলোতে অনেক নির্বাচনই ছিল জৌলুসহীন ও একতরফা। এছাড়া একতরফা নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। এ কারণেই বিএনপির আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন ছিল ভোটারহীন। একইভাবে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও ভোট কম পড়ে। এদিকে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম এবং নির্বাচনে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের দায়ী করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা বলছে, সংসদ সদস্যদের আওতা থেকে উপজেলা পরিষদকে মুক্ত করা না হলে উপজেলা নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া সম্ভব না। গত রোববার বিকালে নিজ কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার বলেন, অনাস্থা থেকেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। যেসব কারণে আমরা ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি, সেসব কারণ খুঁজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। এমতাবস্থায় ভোটারদের ওপর এ দায় চাপানো ঠিক নয়।মাহবুব তালুকদার বলেন, উপজেলা নির্বাচন পরিষদের চতুর্থ ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হলো। স্থানীয় সরকার হিসেবে ঘোষিত উপজেলা পরিষদে স্বায়ত্তশাসন নেই। সংসদ সদস্যদের আওতা থেকে উপজেলা পরিষদকে মুক্ত করা না হলে উপজেলা নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া সম্ভব না। তবে এটি নিতান্তই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।