Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

হালখাতার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা

প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ

এপ্রিল ৩, ২০১৯, ০৬:৫৮ পিএম


হালখাতার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা

আর মাত্র কয়েকদিন পরই পুরান ঢাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী আয়োজন করবে হালখাতার। এটা তাদের কাছে একটি উৎসব। প্রতি বছরই করে থাকেন। তাদের কাছে পহেলা বৈশাখ মানে হালখাতার ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হালখাতা খোলার যাত্রা শুরু হবে বৈশাখের প্রথম প্রহরে। লাল মলাটের পঞ্জিকা দেখেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন ব্যবসায়ীরা। আর লাল মলাটের হালখাতায় লিপিবদ্ধ করা হয় নতুন হিসাব। মোঘল আমলে চৈত্রের শেষের দিকে প্রজারা রাজ-কোষাগারে খাজনা দিতেন। পুরনো হিসেব চুকিয়ে খোলা হতো নতুন খাতা। আর বাকির খাতা শূন্য হওয়ায় রাজ দরবার থেকেও প্রজাদের নানাভাবে আপ্যায়ন করা হতো। সেই থেকে চলে আসছে বাংলা সনের শেষের দিন বা নতুন বছরের প্রথম দিনে হালখাতা আয়োজন করার রীতি। পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খোলা হবে নতুন হিসাবের খাতা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এদিন দোকানে আসতে থাকেন দেনাদার ও পাওনাদাররা। আমন্ত্রিতদের মিষ্টি ও ফল দিয়ে এ দিন আপ্যায়ন করা হয়। আর মাত্র দশ দিন পরই পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ১৪২৬-এর যাত্রা শুরু হবে। দেশের সব জায়গায় এ হালখাতার আয়োজন হয়ে থাকে। তবে রাজধানীতে পুরান ঢাকায় এ আয়োজন হয়ে থাকে। অন্য এলাকায় এ উৎসব তেমন চোখে পড়ে না। ঐতিহ্যবাহী হালখাতা উৎসব আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন তারা। আগের মতো হালখাতা উৎসবের জৌলুস না থাকলেও ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্য হিসেবেই পালন করছেন। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাখারীবাজারের স্বর্ণের দোকান, শ্যামবাজারের আড়তের দোকানগুলোতে হালখাতার আয়োজনটা বেশি হয়। চৈত্র মাসের শুরু থেকেই ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানানোর কাজ শুরু করেন। এ জন্য নিমন্ত্রণপত্রও ছাপানো হয়। দু-তিনদিন ধরে চলে ধোয়ামোছার কাজ। সাধারণত পহেলা বৈশাখের দিন হালখাতা করা হয়। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এটা তাদের জন্য একটি উৎসব। প্রতিবছরই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন তারা। এবছরও এর বিকল্প হবে না। হালখাতা আগের মতো এখন জমে না। তবে তারা ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন এখনো। হালখাতা উপলক্ষে নয়া বাজারের বিভিন্ন খাতা ব্যবসায়ী ও বাইন্ডিং কারখানায় চলছে পুরো ব্যস্ততা। তাদের জন্য এটা একটা বড় মৌসুম। এ সময় তারা লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো খাতা বেশি বিক্রি করে থাকেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই পুরান ঢাকার শাখারীবাজারে ব্যবসা করে আসছেন সুকান্ত কর্মকার। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, যাদের কাছে আমরা আগের বছরের টাকা পাই তাদেরকে ইতোমধ্যে হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছি। সাথে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীকেও নিমন্ত্রণ করেছি। বৈশাখের শুরুর দিন ভোরে দোকানপাট ধুয়ে, সোনারূপার পানি ও গোলাপজল ছিটিয়ে আমরা নতুন বছরের যাত্রা শুরু করব। হালখাতা বা নতুন হিসাবের খাতা ব্যবসায়ীদের শুভ মহরত। প্রায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে হালখাতার রেওয়াজ। কোনো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখন আর খাতা ব্যবহার করে না। তারা এখন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন কম্পিউটারের মাধ্যমে। ব্যবসা নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকেন। তাদের মধ্যে অনেকেই পহেলা বৈশাখে মিলাদ পড়িয়ে হুজুর দিয়ে লাল সালু বেষ্টিত খাতায় বিসমিল্লাহ লিখিয়ে রাখবে। আর অনেকে খাতা ব্যবহার না করলেও হালখাতার আয়োজন করবে বলে জানিয়েছেন। এছাড়াও অধিকাংশ ব্যবসায়ী পহেলা বৈশাখে ঐতিহ্যবাহী লালসালু কাপড়ে বাঁধাই করা টালিখাতা বেছে নেবেন। গতকাল সরেজমিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহেই তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করে ধোয়ামোছা শেষ করে পহেলা বৈশাখের জন্য প্রস্তুত করবেন। অনেকে ইতোমধ্যেই সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে সাজাতে শুরু করেছেন। পুরান ঢাকার ডালপট্টিতে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি দোকান পরিষ্কার করে কাগজ ও বোর্ড দিয়ে সাজাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নতুন করে রং করছেন। বিভিন্নভাবে সাজানো হচ্ছে। তাঁতীবাজারের স্বর্ণের দোকানগুলোর সাজসজ্জা একটু আলাদা। এরই মধ্যে দোকান ও গদিঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। শ্যামবাজারে গিয়ে জানা গেছে, সাধারণ আড়তদাররা পহেলা বৈশাখের দিন হালখাতা করলেও আদা, পেঁয়াজ ও রসুন আড়তদাররা জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে হালখাতা করবেন। এদিকে পাইকারি পান দোকানদাররা চৈত্র সংক্রান্তিতে তা পালন করবেন। পান দোকানদার শিহাব বলেন, হালখাতার দিন আমাদের এখানে নতুন-পুরাতনের একটি মিলনমেলা জমে। পুরাতন ব্যবসায়ীরা তাদের হিসাব শেষ করেন। সাথে সাথে অনেক নতুন ব্যবসায়ীকেও আমরা দাওয়াত করি। এ দুই মিলিয়ে আমাদের এখানে একটি মিলনমেলা হয়। আমাদের এখানে পান ব্যবসা জনপ্রিয়। এছাড়াও জানা যায়, সেদিন তারা সকাল ৮টায় দোকান খোলেন। আগরবাতি জ্বালান, গোলাপপানি ছিটান। সকালে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন হয়ে থাকে মুসলিম দোকানগুলোতে। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিদের টাঙ্গাইলের চমচম ও নিমকি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি করে পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে বছর শুরু করা হয়। তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী নারায়ণ সাহা বলেন, বিদায়ী বছরের হিসাব-নিকাশ চলছে জোরেশোরে। বিদায়ী বছরের লাভ লোকসানের হিসাব শেষ করে পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন হিসাব খোলা হবে। ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত হালখাতার আয়োজন করেন না। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা তা করে থাকেন। অন্যদিকে নয়াবাজার জিবি বাইন্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম আমার সংবাদকে বলেন, গত দুই মাস ধরেই ব্যস্ত সময় পার করছি। রাত দিন কাজ চলছে। প্রতি বছরই এমন সময় আমাদের বেচাকেনা পুরোদমে থাকে, এবারো এর বিকল্প নয়। এ বছর বেচাকেনা অন্য বছরের তুলনায় ভালো হচ্ছে বলে জানান তিনি।