Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

নৌকার পরাজয়ে তৃণমূল দুষছে হাইকমান্ডকে

প্রিন্ট সংস্করণ॥রফিকুল ইসলাম

এপ্রিল ৪, ২০১৯, ০৬:৩৬ পিএম


নৌকার পরাজয়ে তৃণমূল দুষছে হাইকমান্ডকে

গত ১০ মার্চ থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন পাঁচটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে চারটি ধাপের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চার ধাপের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকের প্রার্থীদের পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নৌকার পরাজয়ের জন্য দলের হাই-কমান্ডকেই দুষছেন তারা।সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে গত ১০ মার্চ প্রথম ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন সঞ্জিত কর্মকার। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৪৪৫ ভোট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) প্রার্থীর কাছে ৯ হাজার ৬৪২ ভোটে হেরে যায়। নৌকার পরাজয় নিয়ে নির্বাচনের পর থেকেই সরব রয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানান, এ পরাজয়ে নেতারা দায় এড়াতে পারেন না। দলীয় নেতাকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।স্থানীয় সরকারের ওই নির্বাচনে পরাজয়ের পর উপজেলাটিতে দলীয় কার্যক্রমও শিথিল হয়ে পড়েছে। ২৬ মার্চ শহীদ মিনারে ফুল দেয়া ছাড়া তেমন কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। এমনকি জাতির পিতার জন্ম দিনও এবার দলীয়ভাবে পালিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে কথা হয় নওগাঁ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সক্রীয় কর্মী শরিফুল ইসলাম জরিপের সাথে। তিনি বলেন, তাড়াশে সঞ্জিত কর্মকার হারেনি, হেরেছে নৌকা, হেরেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। একই ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল আহমেদ বলেন, আমরা নেতাদের বিশ্বাস করে হেরেছি কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। বড় বড় নেতারাই নৌকার ভরাডুবির পিছনে কাজ করেছেন। তাড়াশ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনিস প্রধান বলেন, নেতারা মুখে বলেছেন এক আর কাজ করেছেন আরেক, তাই এ পরাজয়।স্থানীয় আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও সলংগা) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নিজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার পরাজয় ঘটে। একই চিত্র দেখা গেছে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ক্ষেত্রেও। এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক ডা মো. আব্দুল আজিজ পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩১ ভোট। অথচ জাতীয় নির্বাচনে মাত্র দুই মাস ১০ দিনের ব্যবধানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সঞ্জিত কর্মকার পেয়েছেন মাত্র ৩৯ হাজার ৪৪৫ ভোট। শুধু তাই নয়, ওই উপজেলায় জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক কখনো হারেনি।নৌকার পরাজয়ের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তাড়াশ উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার সেলিম জাহাঙ্গীর। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি স্ট্যাটাস দেন। তিনি সেখানে লিখেন, হিন্দুদের দিয়ে নৌকার গুন টানাবে আওয়ামী লীগ কিন্তু নৌকায় উঠাবে না। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় প্রতীকের প্রার্থী সঞ্জিত কর্মকার নির্বাচনের পরাজয় মেনে নিয়ে আমার সংবাদকে বলেন, শীর্ষ নেতারা যে যার মতো রোল করেছেন। তবুও মনে করি এ পরাজয় আমার নয়, এ পরাজয় আওয়ামী লীগের। জননেত্রী শেখ হাসিনার নৌকার।শুধু তাড়াশ উপজেলাই নয়, অনুষ্ঠিত পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম চার ধাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নাটোরের গুরুদাসপুরে নৌকার প্রার্থী ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। তাকে পছন্দ না হওয়ার কারণে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দেন স্থানীয় সাংসদ আবদুল কুদ্দুস। তিনি নিজে এবং নেতাকর্মীরা আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়েন নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে। জেলার বাগাতিপাড়ায় একই অবস্থা দেখা দেয়। ফরিদপুর জেলার ৫টি উপজেলায় জয় পায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। সিলেটের ১২ উপজেলার মধ্যে ৭টিতে আওয়ামী লীগ ও ৫টিতে দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন। মৌলভীবাজারের সাতটি উপজেলার মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয় পান। রাজশাহী বিভাগের ১০ উপজেলায় বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বগুড়া জেলায় ৩টি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। গাইবান্ধায় দুটিতে এবং নওগাঁ জেলায় ১টিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। রাঙামাটিতে ৩টি এবং কক্সবাজারে ২টি জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র। দিনাজপুর জেলার ৪ উপজেলায় জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র ও একটি জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন জহির উদ্দিন সিদ্দিক টিটু। কিন্তু ওই প্রার্থী সাংসদের মনোপুত না হওয়ায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মোহম্মদ মনিরুজ্জামানকে নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামেন সাংসদ এবাদুল করিম বুলবুল ও তার অনুসারীরা। সারা দেশেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের একই অবস্থা দেখা দেয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে দেশের ১৩৫টি উপজেলায় নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। অথচ ভোটের মাঠে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো ছিল না। অনেকটা একতরফা এই নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ওই উপজেলাগুলোতে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ৪৪৫টি উপজেলার মধ্যে ১০৭টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। সব মিলিয়ে চার ধাপে আওয়ামী লীগ থেকে ৩০৪ জন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন ১৩৫ উপজেলায় (জাতীয় পার্টি ৩টি ও জেপির এক প্রার্থীসহ)। একটি উপজেলায় ভোটের ফল স্থগিত আছে। গোপালগঞ্জের ৫টি উপজেলায় আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। সেখানে সবাই ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।নাম প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতিতে এক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমার সংবাদকে বলেন, যে সব নেতাকে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য আমরা রাতদিন কাজ করেছি। অথচ আজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নিজের স্বার্থের জন্য নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। এটা খুব দুঃখজনক। তিনি বলেন, আগামীতে জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে নৌকাকে জয়লাভ করানোর জন্য তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীদের একত্র করা যাবে না। আর এটার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই দায়ী।ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. সুবল চন্দ্র সাহা আমার সংবাদকে বলনে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি না আসার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য আমাদের দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে ছিলো। এতে দলীয় ও বিদ্রোহীদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে আর কোনো দূরত্ব নেই। তিনি বলেন, আমাদের তৃণমূলের কর্মীরা একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ থেকে নেত্রীকে যে বিজয় উপহার দিয়েছে, আগামীতেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক আমার সংবাদকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যে সব নেতাকর্মী নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্য দূরত্ব তৈরি করেছে। তাদের বিষয়ে আজ দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।