Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

কয়লা থেকে যাচ্ছে ভূ-গর্ভে

প্রিন্ট সংস্করণ॥মো. আফজাল হোসেন, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর

এপ্রিল ৪, ২০১৯, ০৬:৩৭ পিএম


কয়লা থেকে যাচ্ছে ভূ-গর্ভে

দেশের উত্তর অঞ্চলের ও বাংলাদেশের একমাত্র স্বল্প মাপের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি অপেন মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা না তোলায় ৮০ ভাগ কয়লা মাটির নিচে থেকে যাচ্ছে। সাময়িক লাভের মুখ দেখলেও ৮০ ভাগ কয়লা তোলা হচ্ছে না। ভূ-গর্ভ থেকে মাত্র ১৫-২০% কয়লা তোলা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে। যা ১৪শ ফিট নিচ থেকে সুড়ঙ্গ পথে তোলা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কয়লা বেশ কয়েকটি দেশে তোলা হলেও শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন, ভারত, চীন, অস্ট্রলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তুলে আনা হচ্ছে। তবে, উন্নত প্রযুক্তিতে ওপেন পিট পদ্ধতিতে কয়ল তুলতে যেমন খরচ কম, নিরাপত্তার ঝুঁকি কম ও ৯০ ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মিটানোর জন্য উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পটি ১৯৯৪ সালের ৭ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার ছোটো মাপের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেন। অল্প সময়ের মধ্যে পেট্রবাংলার সাঙ্গে চীনের মেসার্স চায়না মেশিনারিং ইনপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি)’র সাথে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৪ সালের ১ জুন। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাসের মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি বাস্তাবায়নের জন্য বড়পুকুরিয়া এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু করেন। প্রায় ৩০০ একর জমির উপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। ১৯৯৮ সালের ৫ এপ্রিল খনির ভূ-গর্ভে পানি প্রবাহের কারণে খনিতে বিপর্যয় দেখা দিলে কয়লা খনি প্রকল্পের কাজ প্রায় ২২ মাস বন্ধ থাকে। ২ বছর পর ২০০৩ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ করার কথা থাকলেও তা করতে পারেননি। খনির ডিজাইন পরিবর্তন করে নতুন ডিজাইনে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকল্পের কাজ তৎকালীন আবারো ৪ বছর পিছিয়ে যায়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে যায়। প্রথম প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৮৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় করা হয় ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। দেশের উত্তর অঞ্চলের আবিষ্কৃত ৫টি কয়লা খনিতে মজুত ৩১৯৭ মিলিয়ন টন কয়লা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানির উৎস গ্যাস। বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে গ্যাসের ওপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস নির্ভর। দেশের গ্যাস মজুদ যেহেতু অফুরন্ত নয়, তাই আগামী দিনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে উত্তরাঞ্চলের ৫টি কয়লা খনি। দেশে আবিষ্কৃত কয়লা ৫৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য, যা দেশে এ পর্যন্ত আহরিত গ্যাসের প্রায় ৪ গুণ বেশি। দিনাজপুরের ৩টি আবিষ্কৃত খনি বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া। অপরদিকে আরও ৩টি খনি হচ্ছে- রংপুরের খালাশপীর ও জয়পুর হাটের জামালগঞ্জ। শুধু দিনাজপুরের আবিষ্কৃত কয়লা খনিতে মজুদ রয়েছে ১ হাজার ৪৬২ মিলিয়ন টন কয়ল। পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হলেও ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন চলছে। ৬.৬৮ বর্গকিলোমিটার কয়লা ক্ষেত্রে ১১৮ থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় ৬টি স্থরে কয়লার মজুদ ৩৯০ মিলিয়ন টন। এখানে উৎপাদিত কয়লায় সালফারের পরিমাণ ০.৫৩%। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ১৯ জুলাই ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০১ কোটি ৬৬ লাখ ৪ হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন কয়লা উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত কয়লার মূল্য পায় ২৩০ কোটি টাকা। ১৯৮৫ সালে বিওএইচপি নামক একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ী পার্বতীপুর, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আর একটি কয়লা খনি আবিষ্কার করেন। ১৯৯৭ সালে লন্ডনভিত্তিক এশিয়া এনার্জি নামে একটি বহুজাতিক কোম্পানি এই এলাকায় ১০৭টি কূপ খননের মাধ্যমে উন্নতমানের কয়লা আবিষ্কার করেন। এই কয়লা খনিতে ৬.৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ নির্ধারণ করা হয়। ফুলাবাড়ী পৌর এলাকার কিছু অংশ ও পার্বতীপুরের ১টি ইউনিয়ন ও নবাবগঞ্জের ২টি ইউনিয়ন, বিরামপুরের একটি ইউনিয়ন নিয়ে এই বিশাল কয়লা বেসিনটি। ইতোমধ্যে বিদেশি কোম্পানিটি ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যার অর্ধেকের বেশি ব্যয় করেছে ফুলবাড়ীর খনি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। কিন্তু কোম্পানিটির দুর্ভাগ্য। সরকারের নির্দেশ না পাওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিটি কোনো কার্যক্রম করতে পারছে না। বাধা দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে ফুলবাড়ীর পার্শ্ববর্তী কয়লা খনির কার্যক্রম মোটেই বন্ধ করতে পারেনি। রীতিমতো এখন সরকার কোম্পানির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করছে। বর্তমান ভূ-গর্ভস্থ কয়লার পয়েন্ট শেষ যাওযায় নতুন পয়েন্ট তৈরি করে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।নর্থ এবং সাউথ দুটি এলাকাকে কোল জোন তৈরি করে জরিপের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ৪ বছরের মধ্যে অপেন মাইনিং অথবা আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার নতুন পরিকল্পনা চলছে। এতে সরকারকে নতুন করে ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে প্রতি ঘণ্টায় পানি প্রবাহ রয়েছে ১ হাজার ৮০০ মিটার কিউবিক। সেই সঙ্গে রয়েছে রুফ ফল্ট। শত প্রতিকূলতার মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন চলছে। তবে পার্শ্ববর্তী ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে এই খনির কারণে। এখানকার কয়লা দিয়ে ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়েছে। অপরদিকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দীঘিপাাড়া কয়লা খনিটি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর এই খনিটি আবিষ্কার করে। দীর্ঘ ১ যুগ ধরে বেশ কয়েকটি কূপ খনন করে ৫০০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদের পরিমাণ যাচাই করেন। বর্তমান বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রাণালয়ের আওতায় বিসিএমসিএল এর মাধ্যমে ৩ বৎসর মেয়াদি জরিপ কাজ চলছে। জরিপ কাজ শেষে চীনা কোম্পানি দীঘিপাড়া কয়লা খনিটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবেন। এই খনিটির তদারক করছেন প্রকল্প পরিচালক মো. জাফর সাদিক। উত্তরাঞ্চলের ৪র্থ কয়লা খনি হচ্ছে জয়পুর হাটের জামালগঞ্জ। সরকার উত্তর অঞ্চলের ৫টি কয়লা খনি বাস্তবায়ন না করে তেল ও গ্যাস এর উপর নিরর্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হলেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এই এলাকার কয়লা খনিগুলো বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। কিন্তু সরকার ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া কয়লা খনি দুটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর চীনা কোম্পানিকে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তুললে এই খনিগুলোর ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লার অফুরন্ত ক্ষতি সাধন হবে। ৮০ ভাগ কয়লা ভূ-গর্ভে থেকে যাবে, ২০ ভাগ কয়লাও উঠবে না, ব্যয় বাড়বে সরকারের। জার্মানির মতো উন্নয়নশীল দেশ তাদের ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লা ওপেন পিট পদ্ধতিতে তুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তাদের দেশের কয়লা আমাদের দেশের মতো নয়, তারা চিন্তা করে ৫০ বছরের জন্য জ্বালানি মজুদ করছে। এমনকি খনি এলাকার কিছু মানুষকে অন্যত্র এলাকায় পুনর্বাসন করেছে। তাদের দেশের পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিছু সমস্যা রয়েছে যে সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিল তাদের পুনর্বাসন, চাকরি এবং কয়লা পুড়িয়ে এই এলাকার জ্বালানির চাহিদা মিটানো সম্ভব। তাতে এই এলাকায় কৃষি ও শিল্পতে বিপ্লব ঘটবে। ৫টি খনি বাস্তবায়ন করলে এতে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে। এ বিষয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির নতুন কূপ খননের জরিপ রিপোর্ট পাঠনো হয়েছে। রিপোর্টের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে দীঘিপাড়া কয়লা খনির জরিপ কাজ এ বছরে শেষ হবে। সরকারের দিকনিদের্শনা পেলে এই খনিগুলোর কাজ শুরু করা হবে।