Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

শিক্ষকদের চোখে শুধুই অন্ধকার

প্রিন্ট সংস্করণ॥রাসেল মাহমুদ

এপ্রিল ৫, ২০১৯, ০৭:২৮ পিএম


শিক্ষকদের চোখে শুধুই অন্ধকার

শিক্ষকতার মহান পেশাকে ভালোবেসে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করা প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষকের চোখে এখন শুধুই অন্ধকার। বেতন-ভাতা ছাড়া দীর্ঘদিন চাকরি করার পর তারা এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত! যেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক! অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। পরিবার ও সমাজের কাছে অবহেলিত এই শিক্ষক সমাজ এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাই স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ জন্য প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি।তবে এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বিষয়ে সরকার ইতিবাচক রয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থমন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় দিলেই জাতীয়করণ সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে রেজিস্ট্রার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মেয়াদে সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিমাসে ২২ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো একই দায়িত্ব পালন করার পরও তেমন কোনো বেতন-ভাতা মিলছে না ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভাগ্যে। শিক্ষকরা জানান, ১৯৯৪ সালের পর থেকে সারাদেশে প্রায় ১৮ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘাদিন ধরে জাতীয়করণ না হওয়ায় এরই মধ্যে প্রায় তিন হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার মাদ্রাসা চালু রয়েছে। প্রতিটি মাদ্রাসায় শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন করে। সেই হিসাবে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৭৫ হাজার। প্রতিটি মাদ্রাসায় গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সরকারি একই সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ন্যায় ইবতেদায়ি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো ইবতেদায়ির শিক্ষার্থীরাও সরকারের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন। আর মাদ্রাসার এসব শিক্ষকরা প্রাথমিকের শিক্ষকদের মতো সরকারের সকল কাজে অংশগ্রহণ করেন।শিক্ষকরা বলছেন, এখন আমাদের যত শিক্ষক রয়েছেন, এর মধ্যে ১৫১৯টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা নামমাত্র ভাতা পান। এই ভাতার পরিমাণ প্রধান শিক্ষকের জন্য দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের জন্য দুই হাজার ৩০০ টাকা। বাকি মাদ্রাসার শিক্ষকরা ৩৪ বছর ধরে বেতন-ভাতা বঞ্চিত। এই দুর্মূল্যের বাজারে যা অমানবিক ও শিক্ষকদের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়। শিক্ষকদের মানবেতর জীবনের কথা চিন্তা করে রেজিস্ট্রার এসব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো শিগগিরই জাতীয়করণের দাবি জানান তারা। জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকরা। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বারবার আশ্বাস দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলো আর জাতীয়করণ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। আর ৯ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি পালন করা হয়। সে সময় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, অতিরিক্ত সচিব এ কে এম জাকির হোসেন ভুঞাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয়করণের আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙান। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম জাকির হোসেন ভুঞা আমার সংবাদকে বলেন, শিক্ষকরা বারবার আন্দোলনে নেমেছে। আমরাও আশ্বাস দিয়েছি। জাতীয়করণের ব্যাপারে আমরা ইতিবাচক। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় না দেয়া পর্যন্ত এটা করা সম্ভব হবে না। এদিকে জাতীয়করণের এক দফা দাবি নিয়ে গত পাঁচদিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। দাবি আদায়ের জন্য অনশন কর্মসূচির কথাও চিন্তা করছেন তারা। গতকাল শুক্রবারও বাংদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মওলানা এ বি এম আব্দুল কুদ্দুস আমার সংবাদকে বলেন, গত পাঁচদিন ধরে আমরা এখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। ময়মনসিংহের ভবানীপুর গোরস্থান মাদ্রাসার শিক্ষক মো. আলী আমার সংবাদকে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিনাবেতনে চাকরি করছি। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক আজ সমাজে অবহেলিত-লাঞ্ছিত। এ অবস্থা থেকে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। আমরা সরকারকে বারবার অনুরোধ করেছি, কিন্তু জাতীয়করণের কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ করলে শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। আন্দোলনে অংশ নেয়া ধাইরা পাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা শাহজাহান আমার সংবাদকে বলেন, অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছিলাম। কিন্তু বেতন ছাড়া চাকরি করে সমাজে এখন বেশ অবহেলিত হয়ে আছি। নিজের পছন্দমতো বিয়েও করতে পারিনি। এখন সন্তানদেরও ভালোমতো মানুষ করতে পারছি না।শিক্ষক শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো নীতিমাল হওয়া সত্ত্বেও আমরা এখনো অবহেলিত। হচ্ছেনা জাতীয় স্কেলে বেতন। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। বাংলাদশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির দপ্তর সম্পাদক ইনতাজ বিন হাকিম আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সরকারকে বারবার আমাদের অসহায়ত্বের কথা বলেছি। এখনো বলছি। কিন্তু জাতীয়করণের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখছি না। তাই বাধ্য হয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছি। দাবি আদায়ের জন্য অনশন করারও পরিকল্পনাও রয়েছে। সমিতির মহাসচিব কাজী মোখলেছুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত কোডভুক্ত ও কোডবিহীন মাদ্রাসার মধ্যে ১৫১৯টি মাদ্রাসা অনুদানভুক্ত, বাকি মাদ্রাসাগুলো অনুদানবঞ্চিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ন্যায় মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সকল স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।