Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

রাজউকের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক তোষণে মৃত্যুকূপ রাজধানী!

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ৬, ২০১৯, ০৭:৩৮ পিএম


রাজউকের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক তোষণে মৃত্যুকূপ রাজধানী!

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। উন্নয়ন, অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের বিশাল দায়িত্ব এড়িয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে রাজনৈতিক তোষণ মুখ্য হওয়ায় অসংখ্য মৃত্যুকূপের বিপজ্জনক নগরীতে পরিণত হয়েছে বর্তমান ঢাকা। সম্প্রতি বনানীর এফআর টাওয়ারে ঘটে যাওয়া প্রাণহানির মর্মান্তিক ঘটনা মৃত্যুকূপের একটি বাস্তব উদাহরণ। এর আগেও এমন অসংখ্য ঘটনা দেখেছে দেশের মানুষ। চলমান এফআর টাওয়ারের ঘটনায় এ পর্যন্ত কম জল ঘোলা হয়নি। তবুও ভবন মালিকরা ব্যতীত অনুমোদন দেয়া প্রতিষ্ঠান রাউজকের অবৈধ অনুমোদনে জড়িত কোনো কর্মকর্তাকেই চিহ্নিত করা যায়নি আদৌ। বরং এর আগেই ভবনটি অনুমোদন ও নির্মাণ-সংক্রান্ত নথিই হারিয়ে ফেলেছে বলে দাবি করছে রাজউক। এর রহস্য উদঘাটনে নেই পদক্ষেপ। এদিকে, রাজউকের যেসব কর্মকর্তা অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত, এ অনুমোদনে লেনদেন হয়েছিল কি না, প্রয়োজনীয় যেসব কাগজপত্র ছাড়াই অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তার রহস্য আদৌ উদঘাটন না হওয়ায় নথি গায়েবে রাজউকের জড়িত কর্মকর্তাদের রক্ষার ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিভিন্ন মহলের আলোচনায় উঠে আসছে। জমির মালিকরা কৌশলে ভবনটির অনুমোদন অবৈধভাবে নিয়েছেন বলে ইতোমধ্যে প্রচার হলেও রাজউকের যেসব কর্মকর্তা অবৈধ অনুমোদন দিয়ে হাতিয়েছেন অবৈধ অর্থ, তাদের নাম পরিচয়ও জানা যায়নি এখনো। এ সংক্রান্তে পুলিশের মামলায় আসামিও করা হয়নি তাদের। এসব বিতর্কিত ভূমিকার কারণে রাজউককে দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিক তোষণে জড়িত থাকার কথাও চাউর হচ্ছে বর্তমান সময়ে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে এফআর টাওয়ার অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত চারটি চিঠি পাওয়া গেছে। যা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে চালাচালি হওয়া চিঠিগুলোর দুটিতে রাজউক ভবনটিকে বৈধ এবং দুটি চিঠিতে অবৈধ বলে জানায়। জমির মালিক এবং ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও ভবনের একাংশের ক্রেতা কাশেম ড্রাইসেলের করা পৃথক দুটি ব্যাংকঋণের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক দুইরকম প্রতিবেদন দেয়। এর মাধ্যমে ভবনটিকে বৈধ ও অবৈধ ঘোষণা করার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ হয়। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে কাশেম ড্রাইসেল ও ভবননির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের জন্য আবেদন করে। নিয়ম অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে ভবনটি যে বৈধ, সে বিষয়ে রাজউক থেকে একটি চিঠি নিতে হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজউকের অনাপত্তিপত্র জমা দিয়ে তারা ভবনটির ২০, ২১ ও ২২ তলা বন্ধক রেখে তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। রাজউকের এই অনাপত্তিপত্র অনুযায়ী ভবনটি বৈধ। কিন্তু পরের বছর ২০০৭ সালে জমির মালিক ফারুক ভবনটির ষষ্ঠ তলা বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার জন্য রাজউকের কাছে অনাপত্তিপত্র চান। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাজউক চিঠি দিয়ে জানায়, ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন আরও চারতলা বাড়ানো হয়েছে। এমতাবস্থায় ঋণ গ্রহণের আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই। আবার ২০১৩ সালে রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক সংস্থাটির আঞ্চলিক অফিসে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৩ তলার বাণিজ্যিক নকশা বিসি (বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, রাজউক) কমিটি কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, কাশেম ড্রাইসেলের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভবনটির ২১, ২২ ও ২৩ তলার নিবন্ধনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক ২০১৪ সালে এক চিঠি দেয়। তাতে রাজউক জানায়, রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার মতামতের আলোকে ২১, ২২ ও ২৩ তলা হস্তান্তরের আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই। অর্থাৎ ওই অংশ অবৈধ। জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে রাজউক থেকে নিলামের মাধ্যমে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ৩২ নম্বর প্লটটি কিনে নেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। সেখানে ভবন নির্মাণের আবেদন করলে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৮ তলা ভবনের নকশার অনুমোদন দেয় রাজউক। নিজের টাকায় ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) তৈরির কাজ করেন ফারুক। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি একটি চুক্তির মাধ্যমে মেসার্স রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডকে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এল এ মুকুল ভবনটি ১৮ তলা থেকে বাড়িয়ে ২৩ তলা করার প্রস্তাব দেন জমির মালিককে। সে অনুযায়ী জমির মালিক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একই বছরের জুলাই মাসে আরেকটি সম্পূরক চুক্তি হয়। ওই চুক্তির ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভবনটি ১৮ তলা থেকে ২৩ তলা করতে রাজউক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তর থেকে অনুমোদন নেয়ার দায়িত্ব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের থাকবে। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকের কোনো দায় থাকবে না। ২০০৭ সাল নাগাদ ২৩ তলা এফআর টাওয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ইতোমধ্যে মেসার্স কাশেম ড্রাইসেলের মালিক তাসভিরুল ইসলামের কাছে ২১, ২২ ও ২৩ তলা বিক্রি করে দেয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর চুক্তি অনুযায়ী ভবনের ৪৫ শতাংশ জমির মালিককে বুঝিয়ে দেয় তারা। নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, রাজউকের লোকজন জড়িত না থাকলে এ ধরনের অনিয়ম হতে পারে না। বহুদিন ধরেই এই আলোচনা আছে যে, রাজউকের ভেতরে সমস্যা আছে। এখন এর সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকেই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। জমির মালিকপক্ষ দাবি করছে, ১৯৯৬ সালে তারা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে নকশার অনুমোদন নিয়েছিল। সে অনুযায়ী ভবনটি ১৮ তলা হওয়ার কথা। এরপর ভবনটির আর কোনো বৈধ নকশা হয়নি। ২০০৮ সালে জমির মালিক ফারুকের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। তাতে বলা হয়, এফআর টাওয়ারের নকশায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে আরও চারটি ফ্লোর বেশি নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোকে রাজউক অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। ভবনের আরও নানা অনিয়মের তথ্য জানিয়ে আইনি সহায়তা চান জমির মালিক। ২০১০ সালের মে মাসে রাজউকের তখনকার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেন জমির মালিক ফারুক। তিন পাতার ওই চিঠিতে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ, রাজউকের অবৈধ ঘোষণা করা তিনটি তলা কাশেম ড্রাইসেলের কাছে বিক্রির বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি করা ফ্লোর কারো নামে নিবন্ধন হয়েছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। ফারুকের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই চিঠির পর আট বছর পেরিয়ে গেলেও রাজউক এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এই অবস্থায় গত ২৮ মার্চ ভবনটিতে আগুন লাগে এবং ২৬ জন মানুষ মারা যান। আহত হন অন্তত ৭০ জন।এর আগে ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট ওই ভবনের বেসমেন্টে আগুন লেগেছিল। তখন জমির মালিক ফারুকের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় একটি জিডি করা হয়। তাতে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেজমেন্টে অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদির কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। নকশা অনুযায়ী জেনারেটর ও সাবস্টেশনের জন্য নির্ধারিত স্থানটি বিক্রি করে অনিরাপদ ও অরক্ষিত স্থানে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আলাদাভাবে নকশা ও কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। রাজউক কমিটিকে ১৮ তলা পর্যন্ত একটি নকশা এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ২৩ তলা পর্যন্ত একটি নকশা সরবরাহ করে। কমিটির সদস্যরা বলছেন, কোন নকশাটি আসল, তা আরও যাচাই-বাছাই ছাড়া তারা বলতে পারছেন না। সার্বিক বিষয়ে রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, একবার ভবনটিকে বৈধ এবং আরেকবার অবৈধ ঘোষণা করার বিষয়টি আমিও শুনেছি। এ ব্যাপারেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব তথ্য বিশ্লেষণ করছে। তদন্তে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২৩ তলা ভবনের নকশা অনুমোদনের কাগজপত্র রাজউকের কাছে আছে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিক তোষণ মুখ্য হলে এমনই হয়। উন্নয়ন, অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের যে বিশাল দায়িত্ব, তা সবসময় এড়িয়ে গেছে রাজউক। ফলে অসংখ্য মৃত্যুকূপের বিপজ্জনক নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা।