Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

খাদ্যে বিষাক্ত হাইড্রোজ

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ৭, ২০১৯, ১০:৩৮ পিএম


খাদ্যে বিষাক্ত হাইড্রোজ

‘ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই। ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকি চেষ্টায়! খাঁটি জিনিস এ কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ভেজাল নামটা খাঁটি কেবল, আর সকলই মিথ্যে।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। বর্তমান নাগরিকজীবনের অন্যতম উদ্বেগের নাম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি ‘ভেজাল’ খাবার। মজাদার খাবার এখন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা রাজধানীসহ শহর, জেলাশহর, উপজেলা শহর, হাট-বাজারগুলোতে বিভিন্ন মিষ্টি ও বেকারি ব্যবসায়ীরা মিষ্টিজাতীয় খাবারে ব্যবহার করছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ হাইড্রোজ বা ইউরিয়া। যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। এ উপাদান গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের রঙ সাদা করতে ব্যবহার করার কথা থাকলেও বর্তমানে কতিপয় অর্থলোভী ব্যবসায়ী ব্যবহার করছে খাদ্য সাদা বা পরিষ্কার রাখতে। ফলে খাদ্য হচ্ছে বিষাক্ত। এসব নিয়ে গোটা দেশে নিয়োজিত স্বাস্থ্য বিভাগের সেনেটারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদারক না করারও অভিযোগ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের তদারকহীনতায় দিনে দিনে খাদ্যে বিষাক্ত হাইড্রোজ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষিদ্ধ হাইড্রোজ প্রয়োগের ফলে ক্যান্সার, হাঁপানি এবং চর্মরোগ হয়। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক। অল্প পরিমাণ ফরমালডিহাইড গ্যাস ব্যবহারও ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়ার সংক্রমণের কারণ। নিষিদ্ধ হাইড্রোজ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যা গ্রহণের ফলে মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া এ উপাদান পাকস্থলী, লিভার, কিডনিসহ জটিল রোগ সৃষ্টি করে। যেসব খাদ্যে হাইড্রোজ হামেশাই দেয়া হচ্ছে এর মধ্যে রয়েছে— মুড়ি, আখ ক্ষেতের মাড়াই করা গুড়, জিলাপি তৈরিতে, মিষ্টি, মিছরি ও বেকারি সামগ্রী বিস্কুট ও কেক তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। হাইড্রোজ ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সি মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবতী মেয়েদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষ-ত্রুটিসহ আশঙ্কাজনকহারে প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। মুড়ি তৈরি করতে হলে ধান দুবার সিদ্ধ করতে হয়। আর দুবার সিদ্ধ করা ধানের চাল সাধারণত লালচে রংয়ের হয়ে থাকে। এ চাল থেকে তৈরি করা মুড়ির রঙ লালচে হবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি মুনাফালোভী মুড়ি ব্যবসায়ীরা মুড়িকে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করছে হাইড্রোজ বা ইউরিয়া। ফলে মুড়ির রঙ হচ্ছে ধবধবে সাদা। আখক্ষেতে আখ মাড়াই করে কড়াইভর্তি রস জ্বাল দিয়ে যে গুড় তৈরি হয় তার রঙ সাধারণত খানিক লালচে এবং খানিকটা কালো রঙয়ের হয়। কিন্তু তখন এ লালচে ও কালচে গুড়কে সাদা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাউড্রোজ। ফলে তৈরি হচ্ছে সাদা ধবধবে আখের গুড়। মিষ্টিদ্রব্য জিলাপির জন্য তৈরি খামির জমতে বেশ সময় লাগে। কিন্তু দোকানদাররা অল্প সময়ে জিলাপি বানাতে খামিরে হাইড্রোজ মেশায়। এতে একদিকে যেমন সময় কম লাগে অপর দিকে জিলাপির রং হয় সাদা ধবধবে। রসগোল্লা তেলে ভাজার পর হাইড্রোজ মিশ্রিত চিনির সিরায় ছেড়ে দিলে তা ধবধবে সাদা হয়। তালমিছরি নামে সাদা ধবধবে এক ধরনের চিনির তৈরি মিষ্টিদ্রব্য দোকানে পাওয়া যায়। সেই মিছরি সাদা করতে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজ। আর বিভিন্ন মেলায় পাওয়া যায় এসব মিছরির তৈরি হাতি, ঘোড়া এবং সাদা ধবধবে কদমসহ অন্যান্য মিষ্টি সামগ্রী। এগুলো মিষ্টি খাদ্য সাদা ও পরিষ্কার দেখাতে ব্যবহার করা হয় প্রচুর হাইড্রোজ। বেকারি মালিকরা হরেক সাদা বিস্কুট তৈরি করতে ব্যবহার করে ক্ষতিকর হাইড্রোজ। ময়দার তৈরি বিস্কুট সাদা না হওয়ায় তারা অতিমাত্রায় এ হাউড্রোজ ব্যবহার করছে। আর কেক বানানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, পচা ডিম ও হাইড্রোজ। তাতে কেক বেশ মোলায়েম হওয়ায় ক্রেতারা আকৃষ্ট হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যে হাইড্রোজ আছে তা তাৎক্ষণিক সনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেই সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে ল্যাবরেটরিতে এসব খাদ্য পরীক্ষা করলে অবশ্যই হাইড্রোজের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের সেনেটারি ইন্সপেক্টরদের বিরুদ্ধে তদারক না করার অভিযোগ উঠলেও এর সত্যতা স্বীকার করতে নারাজ স্বাস্থ্য বিভাগ। বাংলাদেশ ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. মোররাফ হোসেনের মতে, মানবদেহে নানা ধরনের ক্যান্সার হয়। যার অধিকংশের কারণ আদৌ জানা যায়নি। তবে হাইড্রোজের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক যে ক্যান্সার বিস্তারে সক্ষম তা প্রমাণিত। ফলে পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, অস্থি-মজ্জা জমে যায়।ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজুমার রাইটস সোসাইটির দেয়া তথ্য মতে, ভেজাল খাদ্য খেয়ে দেশে প্রতি বছর তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রায় দেড় লাখ ডায়াবেটিস ও ২ লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কার্বাইডের কারণে তীব্র মাথাব্যথা, ঘূর্ণি রোগ, প্রলাপ বকতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে মেজাজ খিটখিটে এবং স্মরণশক্তির ক্ষতি হতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ফলে কিডনি, লিভার, ত্বক, মূত্রথলি ও ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে।