Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

তিন বছরেও সরবে না কেমিক্যাল গোডাউন!

প্রিন্ট সংস্করণ॥জাহাঙ্গীর আলম

এপ্রিল ৮, ২০১৯, ০৬:১১ পিএম


তিন বছরেও সরবে না কেমিক্যাল গোডাউন!

নিমতলীতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ৯ বছর পর সম্প্রতি চকবাজারের কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে। এতে সারাদেশে ব্যাপক হইচই পড়ে। সব কেমিক্যাল সরাতে টাস্কফোর্স গঠন করে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে বসে। তারপরও তিন বছরে ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন সরবে না। কারণ কেরানীগঞ্জের পরিবর্তে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে যে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তা ২০২২ সালে শেষ হবে। প্রায় হাজার বিঘা জমিতে ২ হাজার ১৫৪টি শিল্প প্লট তৈরি করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। এসব কাজে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। তা যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য কাজ শেষ করে একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য আরও সময় লাগবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে, কেমিক্যাল পল্লী বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় দ্রুততম সময়ে অস্থায়ীভাবে ঢাকার শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে ৫৪টি গুদাম নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিসিআইসি। এটিও বাস্তবায়নে সময় লাগবে এক বছর। কারণ বিসিআইসি ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়ন করবে। একইভাবে টঙ্গীতে বিসিআইসি অপর একটি প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ করবে। এ জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় দুটি প্রকল্প তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। ৭৯ কোটি টাকা করে ব্যয় হবে। প্রকল্প দুটি দ্রুত কার্যকর করতে আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে আগে শোনা গেলেও চূড়ান্ত নোটিস তালিকায় এর স্থান হয়নি। তাই পরিকল্পনা কমিশনসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও কেমিক্যাল সরানো হবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কারণ আজকের একনেকে ৮টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলেও এ দুটি স্থান পায়নি। সার্বিক ব্যাপারে জানতে শিল্পসচিব আব্দুল হালিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা প্রকল্পটির দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি সভা হয়েছে। সভায় কিছু ব্যাপারে সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এসব কাজ শেষ করেই পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধিত ডিপিপি পাঠানো হবে। একনেক সভায় অনুমোদন পেলে শিগগিরই কাজ শুরু হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেরি হলেও সব প্রক্রিয়া শেষ করে কাজ শুরু করতে হবে। এর বেশি কিছু আমি জানি না। তা জানতে হলে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংয়ের যুগ্ম প্রধানের সঙ্গে কথা বলা দরকার বলে জানান তিনি। অন্যদিকে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন মারুফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, খাবার থেকে শুরু করে জুতা-সেন্ডেল সব পণ্যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ব্যবসা সরাতে হলে একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এর আগে নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগলেও সরানো হয়নি। কেটে গেছে বহু বছর। আবারো গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের কেমিক্যাল গোডাউনে ঘটেছে অগ্নিকাণ্ড। অপরদিকে, শিল্প মন্ত্রণালয় কেরানীগঞ্জ থেকে সিরাজদিখানে কেমিক্যাল পল্লী স্থানান্তরের উদ্যোগ নিলেও ব্যবসায়ীরা জানেন না। এটা উদ্বেগের বিষয়। তবে সরানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার যুক্তিযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে জমি অধিগ্রহণ ও কার্যকর স্থাপনা নির্মাণ করে দিলে আমরা সেখানে চলে যাব। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে কেমিক্যাল ব্যবসাকে বিছিন্নভাবে নয়, সংঘবদ্ধভাবে স্থানান্তর করতে হবে। কারণ বিচ্ছিন্নভাবে করা হলে তা এখানকার মানুষের তেমন কোনো উপকারে আসবে না। তিনি আরও বলেন, পণ্য উৎপাদনে যাতায়াতটা বড় ফ্যাক্টর। তাই কেমিক্যাল পল্লী জিঞ্জিরা বা এর কাছাকাছি স্থানে হলে ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হয়। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল সরাতে র্যাব, সিটি কর্পোরেশন অভিযান চালাচ্ছে, এতে আমাদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় ৮০ শতাংশ কেমিক্যাল কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। পুরান ঢাকার এই কেমিক্যাল ব্যবসায়ী আরও বলেন, আমাদের অনেক সমালোচনা হচ্ছে। এতে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে এ খাতে। তাই আমরা সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই। শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশনসহ একাধিক সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার যেখানে-সেখানে রয়েছে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন। প্রায় চার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কেমিক্যাল বিস্ফোরক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ২০১০ সালের ৩ জুন নবাব কাটরার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনের অগ্নিকাণ্ডে অল্প সময়ে ১২৪ জন প্রাণ হারান। এছাড়া সম্পদেরও ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়। এ নিয়ে হইচই পড়লে সরকার উদ্যোগ নেয় কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলার। কিন্তু কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের অনীহা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কেটে গেছে আট বছর। অবশেষে গত বছরের ৩০ অক্টোবর ভোটের আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক সভায় প্রায় ২০২ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন পায় ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ প্রকল্পটি। গত বছরের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা। প্রকল্পটির জন্য ৫০ একর বা দেড়শ বিঘা জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়। প্রকল্পটিতে ৯৩৬টি শিল্প প্লট তৈরির মাধ্যমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়। পাশাপাশি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন ও একটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট স্থাপনের কথা রয়েছে। তবে এ উদ্যোগে অনেক ব্যবসায়ীই কার্যকরভাবে সাড়া দেননি। কারণ হচ্ছে তারা জায়গার পরিবর্তে বিসিকের মতো প্লট চায়। এদিকে, প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়ার আগেই ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণ যায়। এ নিয়ে আবারো সারা দেশে হইচই পড়লে আলোচনায় আসে ঢাকার সব কেমিক্যাল সরানোর। সরকারের পক্ষ থেকেও কেমিক্যাল সরাতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হয়। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে ডিসি অফিস, ভূমি মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিকের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই প্রকল্পে সব কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর স্থান সংকুলান হবে না ভেবে সরে এসেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, সম্প্রতি বড় আকারে কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। যাতে ঢাকার বিশেষ করে পুরাতন ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনগুলো একটি পরিবেশবান্ধব এবং অপেক্ষাকৃত কম ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত একটি কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলা যায়। তাই আরও বড় পরিসরে এবং কম জনবহুল এলাকায় কেমিক্যাল পল্লীটি স্থানান্তর করতে অনুমোদিত কেমিক্যাল পল্লীটি সংশোধন করে শিল্প মন্ত্রণালয়। এর অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে প্রকল্পটি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কেরানীগঞ্জের পরিবর্তে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের তুলশিখালী ব্রিজসংলগ্ন স্থানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। আগের ৫০ একর বা দেড়শ বিঘা জমির পরিবর্তে গোয়ালখালী, চিত্রকুট ও কামারখান্দা মোজায় ৩১৫ একর বা প্রায় হাজার বিঘা ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। প্লটের পরিমাণও ৯৩৬টি থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১৫৪টি শিল্প প্লট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাতে ছড়ানো ছিটানো সব কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর স্থান সংকুলান করা যায়। প্রকল্পের অন্যান্য কাজের মধ্যে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৯৯ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন করা হবে। বড় আকারে ১৭৯ বর্গমিটারের অফিস ভবন নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ করা হবে ৫২ হাজার ৯৫৪ মিটার। এছাড়া সার্বিকভাবে নিরাপত্তার জন্য ৩২৬ বর্গফুটের পুলিশ ফাঁড়ি, একটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিটও থাকবে। থাকবে ২টি জেটি নির্মাণের ব্যবস্থা, গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে ৩টি। প্রকল্পটি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) বাস্তবায়ন করবে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে। এসব কাজের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। তা যাচাই করতে গত ৩১ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি-পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কিছু ব্যাপারে আপত্তি করে সংশোধন করতে বলা হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়কে। সংশোধিত ডিপিপি পেলেই একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে ইতোপূর্বে ঢাকা থেকে কেমিক্যাল স্থানান্তরে অনেক সময় চলে গেছে। এবারো ব্যবসায়ীরা ইতিবাচক মনোভাব না দেখালে কেমিক্যাল পল্লী সরানো সম্ভব নয়।