Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রশ্রয়েই অপকর্মের আঠারো বছর

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ৮, ২০১৯, ০৬:১২ পিএম


ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রশ্রয়েই অপকর্মের আঠারো বছর

ফেনীর সোনাগাজী সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা। ১৮ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা লম্পট সিরাজ উদ-দৌলাহর অপকর্মের ইতিহাসও ১৮ বছরের। চেক জালিয়াতি থেকে শুরু করে লম্পট এ অধ্যক্ষ জড়িত প্রতারণা, নাশকতা ও যৌন হয়রানিসহ নানান অপকর্মে। রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের রোকন এ অধ্যক্ষ দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে বহিষ্কারও হয়েছে দল থেকে। তার বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বেশকটি অপকর্মের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় রয়েছে ৪টিরও অধিক মামলা, জেলও খেটেছেন বিভিন্ন সময়ে। সব অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বর একটি অভিযোগ- ১৮ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মাদ্রাসা ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেই চলছে এ অধ্যক্ষ। যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রী কিংবা তাদের পরিবার লোকলজ্জা কিংবা হয়রানির ভয়ে মুখ না খোলায় এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে গা ঘেঁষে চলায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দেশব্যাপী আলোচিত নুসরাত জাহান রাফির ঘটনা পর্যন্ত ছিল বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয়— এতোটাই ভয়ংকর এ অধ্যক্ষ জেলে থেকেও দাগী সন্ত্রাসীদের মতো মাদরাসা ও এর বাইরে গড়ে রেখেছে আগুন সন্ত্রাসীদের মতো হিংস্র একটি গ্রুপ। নুসরাতের মায়ের করা যৌন হয়রানির মামলার জেরে ঘটে যাওয়া ঘটনাই তার প্রমাণ।ভয়ংকর যৌন সন্ত্রাসী অধ্যক্ষ সিরাজের অনুসারীদের দেওয়া আগুনে শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাত জাহান রাফিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গতকাল বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী সচিব ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া জানান, দগ্ধ নুসরাত জাহান রাফিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি এখানে (ঢামেক বার্ন ইউনিট) এসেছি। প্রধানমন্ত্রী ওই ছাত্রীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচার হবেই। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধ্যক্ষ সিরাজের অতীত খুবই ভয়ংকর। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা কুকর্মের অভিযোগ রয়েছে। চেক জালিয়াতি, প্রতারণা, নাশকতা ও যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফেনী ও সোনাগাজী থানায় ৪টির অধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে চেক জালিয়াতির মামলায় জেলও খেটেছে লম্পট এ অধ্যক্ষ। একাধিক ছাত্রী তার বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ করেছে, এমনকি শিশুদেরও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফেনী জেলার পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, অতীতের সবকিছু মাথায় রেখেই আমরা তদন্ত করছি। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চ মহল থেকেও নির্দেশনা রয়েছে।পুলিশের চচট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন ও ক্রাইম) মোহাম্মদ আবুল ফয়েজের কাছে জবানবন্দি দেওয়া ওই মাদরাসার এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, যৌন হয়রানির ব্যাপারে খুব দক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাহ। ক্লাসে কৌশলে একটা-দুইটা প্রশ্ন বলে দিতেন, সেগুলো পরীক্ষায় চলে আসতো। প্রশ্নফাঁসের লোভ দেখালে ছাত্রীরা যেন বেশি বেশি হুজুরের কাছে যায় সেজন্য তিনি এসব টেকনিক অ্যাপ্লাই করতেন। অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা করলে ভালো। পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করলে পরে যদি কোনো অপরাধীর নাম বাদ পড়ে যায় তাহলে সেসময় জটিলতা সৃষ্টি হবে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ বাদি না হলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে। এরপরই গতকাল বিকালে নুসরাতের বড় ভাই সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাহর নানা অপকর্মের বর্ণনা করে তার একান্ত সহকারী নুরুল আমীন জানান, হুজুরের চরিত্র খারাপ জেনে আমি ছাত্রীদের হুজুরের কাছে বেশি যেতে নিষেধ করতাম। আমি যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ ছাত্রীরা হুজুরের রুমে আসা যাওয়া করতো এটা দেখতাম। আমরা চলে গেলে পরে কি হতো তা জানি না। যৌন নির্যাতনের শিকার পরীক্ষার্থীর সহপাঠী জান্নাতুল কোবরা বলেন, আমরা পরীক্ষাকেন্দ্রে আসতে এখন খুব ভয় পাচ্ছি। আমাদের অধ্যক্ষের চরিত্র খারাপ শুনে আমরা নিজ থেকে হুজুরের কাছে যেতাম না। মা-বাবারা সবসময় আমাদের নিয়ে টেনশনে থাকে। নুরুল আফসার লিটন নামে সোনাগাজীর এক বাসিন্দা জানান, অধ্যক্ষ বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। তার পক্ষেতো এখন কিছু করা সম্ভব নয়। তবে মাদরাসার গভর্নিং বডির কমিটিতে ঢোকার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন দুইভাগে বিভক্ত। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তারের পর থেকে তারা পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন-বিক্ষোভ করেছে। এছাড়া ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রউপ বলেন, প্রশ্নফাঁস ও যৌন হয়রানিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত সিরাজ উদ-দৌলাহ। একসময় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সেখান থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে সাপোর্ট দেন। মাদরাসার গভর্নিং বডির কমিটি নিয়ে বিরোধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত থেকেও পার পেয়ে গেছেন। তবে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাহ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান গভর্নিং বডির সহসভাপতি ও সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমীন। তিনি বলেন, আমরা যখনই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি ব্যবস্থা নিয়েছি। এবারও আমি নিজে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি। এ ব্যাপারে পরীক্ষারকেন্দ্র সচিব নুরুল আফসার ফারুকী জানিয়েছেন, কেন্দ্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পরীক্ষা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে ২০১৬ সালে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফেনী জেলা জামায়াতের আমির এ কে এম শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিন বলেন, এক সময় সিরাজ জামায়াতের রোকন সদস্য ছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ একাধিক অভিযোগ ওঠার পর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যতটুকু জেনেছি ১৮ বছর ধরে এ মাদরাসায় আছেন সিরাজ। এর আগেও একাধিকবার তার বিরুদ্ধে অনেক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। প্রায় প্রতিবারই প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। অপকর্ম আড়াল করতে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। মাদরাসা ঘিরে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ারও অভিযোগ আছে।সর্বশেষ গত ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগাম প্রশ্নপত্র দেওয়ার কথা বলে অনৈতিক প্রস্তাব দেন শিক্ষক সিরাজ। পরে মেয়ের শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন মা। বর্তমানে সেই মামলায় শিক্ষক কারাগারে থাকলেও থেমে নেই তার অনুসারীরা। গত ৬ এপ্রিল সহপাঠীকে মাদরাসার ছাদে মারধর করা হচ্ছে বলে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বোরখা পড়া ৪ মুখোশধারী। যাদের কণ্ঠ পরিচিত মনে হচ্ছে বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বড় ভাইয়ের কাছে জানিয়েছেন নুসরাত। নুসরাত জানিয়েছে, তাদের হাত ফর্সা দেখলেও বোরখা পড়া থাকায় স্পষ্ট চিনতে পারেনি সে। এরআগে তার ভাই অভিযোগ করে বলেন, ওই মাদরাসার দারোয়ানও এ ঘটনায় জড়িত। দারোয়ান কেন নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া তার মামাতো ভাইকে মাদরাসায় ঢুকতে দেয়নি। এখানে যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তাতে দারোয়ানকে আটক করে জিজ্ঞাসা করলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে দাবি করে নুসরাতের ভাই। এদিকে, শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতকে গতকাল অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার সিধান্ত নেয় ৯ সদস্যের করা মেডিকেল বোর্ড। কিন্তু শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে নুসরাতকে তাৎক্ষণিক ঢামেক বার্ন ইউনিটের লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢামেক থেকে জানানো হয় নুসরাত লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। এদিকে, খুব কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে নুসরাত তার ভাইকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী যেন তাকে বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনদিন পর সর্বশেষ গতকাল বিকালে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলা করেছে ভুক্তভোগীর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান। এ পর্যন্ত হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটকরা হলেন— মাদরাসার প্রভাষক আফসার উদ্দিন, ছাত্র আরিফুল ইসলাম, মো. মোস্তফা, নুরুল আমিন, আলাউদ্দিন, সাইদুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আফসার উদ্দিন। সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অজ্ঞাত বোরখা পরা মুখোশধারী চারজনসহ সহযোগীদের আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাই। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহ পুলিশ সাতজনকে আটক করেছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া রাফির সহপাঠীদের কাছ থেকে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।