Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

৪২৩ দিনের জবাব নেই শীর্ষ পর্যায়ে!

প্রিন্ট সংস্করণ॥আবদুর রহিম

এপ্রিল ৮, ২০১৯, ০৬:১৪ পিএম


৪২৩ দিনের জবাব নেই শীর্ষ পর্যায়ে!

*সবার সঙ্গে কথা হয় তারেকের!
*আবেগ-ক্রন্দনে ফখরুলের আহবান!
*মায়ের জন্য রিজভীর শতশত ব্রিফিং

৪২৩ দিন বিএনপির নেতৃত্বের বাইরে খালেদা জিয়া! দিন-বছরের হিসাব পেরিয়েছে দুই মাস আগে। এখন কারাগারেই চলছে জীবনধারা। অবশেষে সভা-সমাবেশে দলের হাইকমান্ডের কাছে খালেদার মুক্তিতে ব্যর্থতার জবাব চাইছেন মাঠপর্যায়ের নেতারা। কিন্তু দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এর কোনো জবাব দেয়া হচ্ছে না। খালেদা জিয়ার জামিন ব্যতীত প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সমপ্রতি আলোচনায় এলে বিএনপিতে শুরু হয় সন্দেহ। অনেকের ইশারার তীর তারেক-ফখরুলের দিকে। দলীয় নেতাকর্মীদের ধারণা, সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় খালেদা অধ্যায়ের অবসানে লন্ডন বুদ্ধিজীবীদের ফাঁদে পড়েছে বিএনপি। এখন আপাতত বিএনপি রাজনীতিতে টিকে থেকে খালেদা জিয়ার অনুসারীদের বিদায়ের প্রক্রিয়া চলছে। এমন ইঙ্গিত অনেক নেতাই পেয়েছেন। গত রোববার খালেদা জিয়ার মুক্তিতে একটি আবদ্ধ কক্ষে গণঅনশনে দলের শীর্ষ এক নেতা এভাবেই প্রকাশ্যে বলেছেন- গোঁজামিল দিয়ে চলবে না এখানে, গোঁজামিল বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ডাকুন মহাসচিব, স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবো আমরা। রাজপথে নামুন কর্মসূচি দিন... আন্দোলন না করে বিএনপির বড় পদধারী নেতারা কি করছেন। ঘরে-বাইরে এর ব্যাখ্যা না তুলে ধরায় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার দল।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলীয় ফোরামে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে লন্ডনে পলায়নরত তারেক জিয়া এখন সিদ্ধান্তের মালিক। তারেক জিয়ার নির্দেশেই বিএনপি চলছে। দলে এ নিয়ে অনেক ঝড়ও বইছে। খালেদার মুক্তিতে যাকেই ভূমিকা পালন করতে বলা হয়, তখন সবাই সবকিছু তারেক জিয়ার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। অনেক নেতা এভাবেই বলছেন, তারেক জিয়ার সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে, এ মুহূর্তে দলে আমার কি ভূমিকা থাকা দরকার তারেক জিয়া আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমি সেই মতেই কাজ করছি। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে ভূমিকা পালনের জবাবদিহির জায়গায় এলে স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যন, উপদেষ্টা ও নির্বাহী সদস্যসহ সবাই এমন উত্তর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের মত, এমন দাবির প্রেক্ষিতে দলের কর্মকাণ্ডগুলোতেও এর প্রভাব দৃশ্যত। দু-একজন স্থায়ী কমিটির নেতাকে নিয়ে ফখরুল চাঙ্গা গুলশানে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি গুলশানে আসছেন। কিছু নেতা নিয়ে বৈঠকও করছেন। দলে এমন অভিযোগও রয়েছে, শান্তিপ্রিয় কিছু নেতা নিয়ে ফখরুল তার বাসায়ও অনেক প্রোগ্রাম করে যাচ্ছেন। আর রুহুল কবির রিজভী চাঙ্গা পল্টনে। ২৪ ঘণ্টার বড় অংশজুড়েই তিনি সিরিজ মিটিংয়ে ব্যস্ত। যখন মন চাচ্ছে তখন মাঝে মধ্যে ১৫-২০ লোক নিয়ে মিছিলও করছেন। দলটির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, আসলে তারেক জিয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কয়জন নেতার সঙ্গে কথা বলেন এটি নিয়ে সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে। পল্টন অফিসের রিজভীর ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি আমার সংবাদকে এমন তথ্যও দিয়েছেন, মাঝে মধ্যে অনেক জেলা সভাপতিও রিজভী ভাইয়ের কাছে এসে বলে তারেক জিয়া তার সঙ্গে কথা বলেছে, কিছু দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। কিন্তু তারেক জিয়া কী আদৌ এমন নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা, কিংবা ফখরুলকে এক নির্দেশনা, স্থায়ী কমিটির অন্য সদসদের আরেক ধরনের নির্দেশনা, ভাইস চেয়ারম্যানদের সাথে কী আদৌ তারেক জিয়ার কথা হয় কিনা, যখন জেলা সভাপতিও এসে বলেন, তারেক জিয়া তাকে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন এমন কথার সত্যতা কী? জানেন না কেউ। তবে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, এখন শুধু মহাসচিবের সঙ্গেই নিয়মিত কথা হয়। মির্জা ফখরুলের মহাসচিবের ভূমিকায় তুষ্ট। তবে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ কিছু স্থায়ী কমিটির সঙ্গে তারেকের দূরত্ব আছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের মত।খালেদা জিয়ার মুক্তিতে ৪২৩ দিনে দলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভূমিকা কী ছিল- এ নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকে এমন প্রশ্নও তুলেছেন, ফখরুল পারিবারিক আদর্শে জাতীয়তাবাদ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, তবুও কেন তাকে দলের এমন বড় পদ দেয়া হয়েছে। যে কিনা আজীবন দিয়ে এসেছে বামপন্থি স্লোগান, শেষ জীবনে এসে জাতীয়বাদ স্লোগান কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন এমন প্রশ্নও তুলেছেন। জানা গেছে, এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে ফখরুলের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি। দলের অন্য স্থায়ী কমিটির সদস্যরা যখন আন্দোলনে যাওয়ার মত দিয়েছিলেন তখন ফখরুল কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বুঝিয়েছেন। যদিও নির্বাচনে যেতে শুরু থেকেই খালেদা জিয়া রাজি ছিলেন না। খালেদাকে কারাগারে রেখে দীর্ঘ এই সময়ে মহাসচিবের ভূমিকা কি ছিলো এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। খালেদাকে কারাগারে ৪২৩ দিন রেখে ফখরুল শুধু আবেগ-ক্রন্দনেই সময় পার করেছেন। নরম ভাষায় মানবন্ধনে-প্রেস ব্রিফিংয়ে মুক্তির জন্য আহ্বান করেছেন। বহু সময় খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ এলে গণতন্ত্রের জন্য অঝোরে কান্নাও করেছেন। আবার কখনো আবেগাপ্লুতও হয়ে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে দলের অনেক নেতা ক্ষুব্ধও! যেখানে দল পরিচালনায় মহাসচিব দৃঢ নয়, সেখানে তাহলে তৃণমূলের কী অবস্থা হবে। মহাসচিবের আবেগ-কান্নায় দলে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বলেও দাবি উঠেছে। অনেকে মন ভেঙে মাঠে নামার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। এদিকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রতিদিনই খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ব্রিফিং করছেন। এতে বিরক্ত অনেকেই। নির্বাচনের দিন রিজভী তার ভোটও প্রয়োগ করতে যাননি। সেদিনও পল্টনে বসে ছিলেন! এছাড়া দলীয় কোনো কর্মসূচিতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন না। স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যন, উপদেষ্টারা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নিয়ে রাজধানীর কোথাও মাঠে নামলে রিজভী তখন সেই কর্মসূচি পল্টনের আবদ্ধ কক্ষে পালন করেন। গত রোববার খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির শীর্ষ নেতারা ‘গণঅনশন’ পালন করলে রিজভী তখন কয়েকজন নেতা নিয়ে অনশন পালন করেন পল্টন দলীয় অফিসের একটি কক্ষে! এছাড়া সাবেক ও বর্তমানের ছাত্রদল-যুবদলের মাঠপর্যায়ের নেতাদের বাদ দিয়ে ডা. কামালকে নিয়ে বুড়োদের ঐক্য গঠন করায় দলে বহু আগ থেকেই বিচ্ছিন্ন বিভেদ চলছে। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই বলেছিল বিএনপি বুড়োদের ঐক্য দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে যুবকদের লাগবে। একই কথা তাৎক্ষণিক সাবেক ছাত্রদল-যুবদলের নেতারাও বলেছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াইয়ে মাঠের শক্তি প্রয়োজন। দিন শেষে অবশেষে সেই আশঙ্কার কথাই সত্য হলো। বুড়োদের ঐক্যে বিধ্বস্ত হলো বিএনপি। সভা-সমাবেশে শীর্ষনেতারা জবাব চেয়ে বসছেন। সমপ্রতি বিএনপির অনশনে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গোঁজামিল বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কাজ যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে কী হয়েছে? হয় নাই! ৪৩টা থানা, ৪৩ হাজার লোক বাইরে থাকতে পারতো না, নাই! তিনি আরও বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ১৪ মাস হয়ে গেছে, দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যন কোথায়? ১শ জন অ্যাডভাইজার কোথায় এখানে? সম্পাদকমণ্ডলী ৩শ জন কোথায়? ৬৮৬ জন কোথায় এখানে? গোঁজামিল দিয়ে চলবে না এখানে, গোঁজামিল বন্ধ করতে হবে...। গোঁজামিল বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ডাকুন মহাসচিব, স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবো আমরা। রাজপথে নামুন কর্মসূচি দিন...। এদিকে হঠাৎ রাজনীতির মাঠে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির খবর! ক্ষমতাসীন সরকার থেকে বলা হচ্ছে, সঠিক প্রমাণের আলোকে আবেদন করলে সরকার খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে চিন্তা করবে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- তারা এ বিষয়ে কোনো আবেদন এখনো করেনি। এটি রাজনৈতিক গুঞ্জন বলে খালেদার দল থেকে দাবি করা হচ্ছে । পাল্টাপাল্টি এমন বক্তব্যে সচেতন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে সরকার কি আসলে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চাচ্ছে নাকি শুধু রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানো হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে লটির ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আমি বারবার বলেছি- প্যারোলের বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়। এখানে ম্যাডাম প্যারোল চাইবেন কিনা এবং সরকার প্যারোল দেবে কিনা- এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা আইনজীবী হিসেবে এটুকু বলতে পারি যে, চিকিৎসার জন্য প্যারোল চাওয়া যায়। রাষ্ট্রও প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানে প্যারোলে মুক্তির বহু নজির আছে। রাজবন্দিদের প্যারোলে মুক্তির ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। আমরা চাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আইনগতভাবে মুক্তি দেয়া হোক।দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভাষ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বক্তব্য এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্য বিপরীতধর্মী। এতে বোঝা যায়, তারা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা নিয়ে নিষ্ঠুর তামাশা করছেন। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আদালতের প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রভাব থাকায় খালেদা জিয়া জামিনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তির সম্ভাবনা নেই। তার মুক্তির একমাত্র পথ- রাজপথে আন্দোলন। এর বিকল্প নাই।গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, খালেদা জিয়া কারো অনুকম্পায় আগেও মুক্তি নেননি, ভবিষ্যতেও চাইবেন না। কেউ যেন তাকে দয়া দেখানোর দুঃসাহসও না করে। তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির কথা বলেনি। খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যে মামলায় তাকে ‘জোর করে’ সাজা দেয়া হয়েছে, সেই মামলার অন্য আসামিরা জামিনে রয়েছেন। তাই তারও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।