Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

প্রতিশোধের হাতিয়ার আগুন!

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

এপ্রিল ৯, ২০১৯, ০৬:১০ পিএম


প্রতিশোধের হাতিয়ার আগুন!

*এবার নরসিংদীতে ঘুমন্ত অবস্থায় প্রতিপক্ষের আগুনে দগ্ধ ৩ ছাত্রীসহ ৪ জন
*লালমনিরহাটে দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা
*লাইফ সাপোর্টে রেখেই ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির অস্ত্রোপচার

প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের অসংখ্য ঘটনা জানা থাকলেও সম্প্রতি ‘আগুন’ হয়ে উঠছে প্রতিশোধের মুখ্য হাতিয়ার। দ্বন্দ্বে জড়ানো দুটি পক্ষের পরাজিত পক্ষ প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে মিথ্যা মামলা, ভাড়াটে খুনি, গুম কিংবা নিজেই উদ্ধত হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়ার হাজারো ঘটনার নজির রয়েছে দেশব্যাপী। কিন্তু সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জামায়াতের বহিষ্কৃত সাবেক রোকন সিরাজ দৌলাহর পোষ্যবাহিনীর আগুনে পুড়ে মৃত্যুশয্যায় থাকা নুসরাত জাহান রাফি, নরসিংদীর রায়পুরায় পূর্ববিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের দেয়া আগুনে ঘুমন্ত তিন শিক্ষার্থীসহ চারজন দগ্ধের ঘটনাসহ লালমনিরহাটে দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে স্বামীর দেয়া আগুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধের হাতিয়ার হয়ে উঠছে আগুন- এমনটাই মনে করছেন অনেকেই। অপকর্মের দীর্ঘ ১৮ বছরের মধ্যে গত দুবছরে দফায় দফায় যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নুসরাত রাফি সর্বশেষ ২৭ মার্চ ফের যৌন হয়রানির শিকার হলে রাফির মা বাদি হয়ে মামলা করলে সে মামলায় বর্তমানে জেল খাটছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ লম্পট সিরাজ দৌলাহ। ক্ষোভ সহ্য করতে না পেরে মাদ্রাসার ফান্ড থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির অর্থায়নে পোষ্য সিন্ডিকেটকে নির্দেশ দেন রাফিকে দিয়ে যেকোনো পন্থায় মামলা উঠিয়ে নিতে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতা ছাড়াও স্থানীয় কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা, মাদ্রাসার পিয়ন নুর আলম, সিরাজ দৌলাহর গড়ে তোলা ছাত্রাবাসের বেশকজন ছাত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট সিন্ডিকেট নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে মামলা তুলে নিতে বলে। তাদের কথায় সায় না দিলেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে রাফিকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। বর্তমানে জীবনশঙ্কায় থাকা রাফি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রাফির শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি যে তাকে সিঙ্গাপুরেও নেয়া যাচ্ছে না। ঢামেক বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্তলাল বলেছেন, রাফির অবস্থার উন্নতি-অবনতি কোনোটাই নেই। তবে গতকাল শ্বাসকষ্টের সমস্যা একটু কমায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।আগুন সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার আগে পুলিশের কাছে দেয়া রাফির জবানবন্দি থেকে জানা যায়, কীভাবে বাবার বয়সি একজন শিক্ষক তাকে শ্লীলতাহানি করেছে। কেবল ২৭ মার্চই নয়, গত দুবছর বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষ সিরাজ দৌলাহর হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে রাফিকে। রাফি জবানবন্দিতে জানায়, ‘আমার ক্লাসে একটা অ্যাকসিডেন্ট হইছে, কেউ একজন আমাকে চুন মারছে। ফালাইছে চুনগুলো, এইরকম যে চুনগুলো আমার চোখে পড়ছিলো। সেটা নিয়ে নিউজ হইছিল। ওটা তো আমার লাইফে কলঙ্ক হয়ে গেছে। রাফি আরও বলে, ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আমাকে তিনবার ডাকছিল। আমি এক হুজুরকে বলছি যে, হুজুর- আমাকে প্রিন্সিপাল হুজুর এই কথা বলতিছে, খারাপ খারাপ কথা। উনার নাকি আমাকে ভালো লাগে। উনি আমাকে শক্ত হতে বলেছে। তারপর আমি উনাকে (প্রিন্সিপালকে) বলেছি, আমার জীবনে একটা কলঙ্ক হয়ে গেছে আমি জানিও না। উনিও ওইটার সুযোগ নিছে। উনি বলেছে যে, তোকে আর কেউ বিশ্বাস করবে না। তোর লাইফে তো আগে একটা কলঙ্ক আছে। তুই আমার সাথে থাক। উনি আমাকে পিয়ন দিয়ে ডাকছে। পিওনের নাম নুর আলম। উনি আমাকে বলেছে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন দেবে।’ অধ্যক্ষ সিরাজ দৌলাহর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এটিই প্রথম নয়। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে গোবিন্দপূর্বদা মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায়ও নৈতিক অবক্ষয় এবং ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, সে মাদ্রাসা থেকেও তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া ওই মাদ্রাসার তিন ছাত্রীও তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অভিযুক্ত এ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগও করেছেন এলাকাবাসী।
এদিকে রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহার পরিবর্তন করে মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে প্রধান আসামি রেখে আরও সাত জনের নাম উল্লেখ করে নতুন করে এজাহার সংশোধন করা হয়েছে। যেখানে আসামি রাখা হয়েছে বোরকা পরিহিত অজ্ঞাতনামা চারজন ও তাদের সহযোগীদের। গত সোমবার রাতে পরিবর্তন করা এজাহারে যুক্ত নতুন আসামিরা হলেন- সোনাগাজী পৌর কাউন্সিলর মকসুদুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নুর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের। এর আগে, শুরুতে ওই মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ দৌলাহকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত পরিচয় চারজন ও তাদের সহযোগীকে আসামি করা হয়েছিল। সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সোমবার রাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আটজনের নাম উল্লেখ করে ও বোরকা পরিহিত চারজনসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ওই শিক্ষার্থীর ভাই। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, অধ্যক্ষ সিরাজ দৌলাহর নির্দেশে উল্লেখিত আসামিরা পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে তার বোনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ দৌলাহ একই শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গত ২৭ মার্চ থেকে কারাগারে রয়েছেন। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত সাতজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ‘ডাইং ডিক্লারেশনে’ দেয়া বক্তব্যে নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা জানিয়ে একজনের নাম শম্পা বলে জানায় রাফি। শম্পাই তাকে শ্রেণিকক্ষ থেকে ডেকে ছাদে নিয়েছিল। রাফির বক্তব্যের ভিত্তিতে গতকাল শম্পাকে আটক করে পুলিশ। ফেনী জেলা পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার শম্পাকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও শম্পার কাছ থেকে কোনো তথ্য জানা গেছে কিনা এমন প্রশ্নে তদন্তের স্বার্থে তিনি কিছু বলেননি।ফেনীর এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নরসিংদীর রায়পুরায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের দেয়া আগুনে তিন শিক্ষার্থী বোনসহ একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়েছেন। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ধারণা করছে, কয়েক বছর আগের একটি হত্যা মামলার জেরে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। মঙ্গলবার ভোরে প্রতিপক্ষের দেয়া ওই আগুনে দগ্ধ হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রীতি আক্তার (১১), অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুইটি আক্তার (১৩) ও এসএসসি পরীক্ষার্থী মুক্তামনি (১৬)। তাদের সঙ্গে আরও দগ্ধ হন তাদের ফুফু খাতুন্নেছা (৬০)। ঘটনার পর রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলেও অবস্থার অবনতি দেখে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় তাদের। বার্ন ইউনিটের মেডিকেল অফিসার ডা. এনায়েত কবির জানিয়েছেন, রায়পুরা থেকে চারজন দগ্ধ রোগী এসেছে। তাদের সবার দুই হাতসহ মুখ ও শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এর মধ্যে খাতুন্নেছার শরীরের ১২ শতাংশ, প্রীতির ১৫ শতাংশ, মুক্তামনির ১০ শতাংশ ও সুইটির শরীরের ১৫ শতাংশ আগুনে দগ্ধ হয়েছে। দগ্ধদের বড় বোন রত্না আক্তার জানান, প্রতিবেশী শিপন, কাজলদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জের ধরে কয়েক বছর আগে মিথ্যা হত্যা মামলা দেয়া হয় আমার দুই ভাই সোহাগ ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে। তারা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে বাবা (শামছুল হক) মারা যান। তারপর থেকে আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। রত্না জানান, মঙ্গলবার ভোরে তারা সবাই বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। তখন পাশের বাড়ির শিপন, কাজল, রবিন, লোকমানসহ কয়েকজন এসে তাদের ঘরে বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুলাল মিয়া হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বিপ্লব মিয়ার পরিবার গা ঢাকা দিয়েছিল। কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়ে গত সোমবার নিজ বাড়িতে আসে বিপ্লব মিয়ার পরিবার। এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কিভাবে তাদের বাড়িতে আগুন লেগেছে, তা তারা জানেন না। রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কবির বলেন, যারা আহত হয়েছে, এলাকায় তাদের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। এর আগে এলাকায় পরপর দুটি মার্ডার হয়। সেই হত্যা মামলার আসামি এদের দুই ভাই সোহাগ ও বিপ্লব। এর মধ্যে বিপ্লব এলাকায় ডাকাত হিসেবে পরিচিত। সেই ঘটনার জের ধরে ঘটনাটি ঘটতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওসি আরও বলেন, এ ঘটনাটি অগ্নিকাণ্ড নাকি পেট্রোল বোমা থেকে, সে বিষয়ে এখনো আমরা স্পষ্ট তথ্য পাইনি। আহতদের খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।কোথাও মামলা তুলে নিতে আবার কোথাও জমি নিয়ে কিংবা খুনের বিরোধকে কেন্দ্র করে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটলেও লালমনিহাটের পাটগ্রাম পৌরসভার নিউপূর্বপাড়া এলাকায় দাম্পত্য কলহের জেরে রোজিনা বেগম (২০) নামের এক গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আব্দুল্লাহ (২৫) নামে এক পাষণ্ড স্বামী। চুরি ও মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত আব্দুল্লাহ প্রায় সময়ই তার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করতো বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে রোজিনা বেগম তার স্বামীকে আত্মীয় আসার খবর জানিয়ে বাড়ির শৌচাগার ঠিক করতে বললে এতে ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আব্দুল্লাহ। এ ঘটনায় গৃহবধূ রোজিনার গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। আগুনের তাপ সইতে না পেরে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুরু করলে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে রোজিনাকে উদ্ধার এবং আব্দুল্লাহকে আটক করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করে। এক সন্তানের জননী রোজিনা বেগম রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় আব্দুল্লার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।