Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বুড়িগঙ্গার বিষফোঁড়া ৩৩ ডকইয়ার্ড

প্রিন্ট সংস্করণ॥আসাদুজ্জামান আজম

এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০৬:২৩ পিএম


বুড়িগঙ্গার বিষফোঁড়া ৩৩ ডকইয়ার্ড

বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত ও ব্যবহার উপযোগী করতে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ছোট-বড় লঞ্চ-স্টিমার তৈরি ও মেরামতের জন্য ৩৩টি ডকইয়ার্ড। অননুমোদিত এসব ডকইয়ার্ডের কারণে নদী দূষণ, পাড় সংরক্ষণসহ নৌপথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ভূমি প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় অন্তত অর্ধশত বছর ধরে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ডগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। বুড়িগঙ্গাকে আপন রূপে ফিরিয়ে দিতে ডকইয়ার্ডগুলোকে সরানোর সুপারিশ করেছে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি। কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনাসহ করনীয় বিষয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ে আজ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে ৩৩টি ডকইয়ার্ড সরানোসহ দখলকৃত জমি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।তথ্য মতে, ঢাকা নদীবন্দরের সদরঘাট বাংলাদেশের নৌ-চলাচলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পথ। এ ঘাট থেকেই সমগ্র বাংলাদেশে নৌ-চলাচল করে। প্রতিদিন শত শত লঞ্চ, স্টিমার এ ঘাটসহ আশপাশে যাত্রী ওঠা-নামা করে। অনেক সময় জাহাজ-স্টিমার বার্থিং করার মতো জায়গা থাকে না। এমন জনাকীর্ণ পরিবেশের মধ্যেই দীর্ঘ সময় ধরে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরের কালীগঞ্জ ও মীরেরবাজার মৌজায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক ডকইয়ার্ড। এরমধ্যে ৩৩টি ডকইয়ার্ড বুড়িগঙ্গার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কামরাঙ্গীরচর থেকে পানগাঁও পর্যন্ত দুই তীরের অন্তত ২০ একর জায়গাজুড়ে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ডকইয়ার্ডগুলোর মালিকানায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ, বিরোধীদল জাতীয় পার্টিসহ রয়েছে প্রভাবশালীরা। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে সরকার দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার বর্জ্যের পাশাপাশি এগুলোর বর্জ্যও দূষণের মাত্রা ভয়াবহ বাড়িয়ে দিয়েছে। ডকইয়ার্ডগুলোতে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নেই? ভারী লোহার শিট বহন করেন শ্রমিকরাই। শিশুদের দিয়েও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়াকড়ি নির্দেশনার পর নড়েচড়ে বসে নৌ মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ডগুলো আইনের আওতায় আনতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদারকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। কমিটিতে ভূমি মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, বিআইডাব্লিউটিএ এবং ডকইয়ার্ডের মালিক প্রতিনিধিও রাখা হয়। কমিটি ডকইয়ার্ডে জমির মালিকানা পর্যালোচনা, পরিদর্শন, স্থানান্তরের উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণ, ভূমি অফিস পরিদর্শন, সকল দলিল ও রেকর্ডপত্রাদি পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরিদর্শনকালে কমিটির নজরে আসে— ডকইয়ার্ডগুলোর অবস্থানের বিপরীতে নদীতে এলোপাতাড়িভাবে লঞ্চ, স্টিমার, বার্থিং ও ডাম্পিং করার। ডকইয়ার্ডের স্লিপওয়ে নদীর মধ্য পর্যন্ত স্থাপন করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ লাইসেন্স এবং নৌ পরিবহন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য পরিদপ্তর অনাপত্তিপত্রও দিয়েছে। ৩ জন ব্যতীত অন্যরা মালিকানার সমর্থনে দলিল দেখাতে পারেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়— ৩৩টি ডকইয়ার্ডের মধ্যে ২৭ জন মালিকের দলিল ও রেকর্ডপত্রাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বাকি ৬ মালিকের দলিল ও রেকর্ডপত্রাদি পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আবারো অনুরোধপত্র পাঠালে ২ জন মালিক কাগজপত্র জমা দেন। বাকি প্রিন্স আওলাদ ডকইয়ার্ড, শামসুল হক ডকইয়ার্ড, সাত্তার ডকইয়ার্ড এন্ড খান ইঞ্জিনিয়ারিং একাধিকবার তাগাদা সত্ত্বেও দাখিল করেনি। মালিকানা দাবির স্বপক্ষে সিএস রেকর্ড, সিএস মানচিত্র, নামজারির কাগজপত্রাদি কেরানিগঞ্জ দক্ষিণ সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে সংরক্ষিত নেই। ৩৩টি ডকইয়ার্ডের দখলকৃত জমির বিষয়ে দলিল ও রেকর্ডপত্র মীরেরবাগ মৌজার খতিয়ান দাগ- ৩৬৬-এ বালুচর দেখানো হয়েছে। ওই দাগে ১৬ একর জমি বিভিন্ন ডকইয়ার্ডের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেওয়া আছে। কিন্তু এসএটিএ, ১৯৫০ এবং প্রাকৃতিক জলাধার আইন-২০০০-এর ধারা ৫ ও ৬ অনুযায়ী বালুচর বন্দোবস্ত এবং নদীর জমি শ্রেণি পরিবর্তন করা বেআইনি বলে উল্লেখ করা হয়।আরও বলা হয়— ডকইয়ার্ডগুলো গড়ে ওঠার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ দায়ী। জেলা প্রশাসক ও বিআইডব্লিউটিএ তাদের দায়িত্বে শিথিলতার কারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দিনের পর দিন অবৈধভাবে বুড়িগঙ্গার গতিপথ দখল করে নৌ-চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে— যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।কমিটির সুপারিশে বলা হয়— মীরেরবাগ ও কালীগঞ্জ এলাকায় স্থাপিত ডকইয়ার্ডগুলোর অনুকূলে নদীর ভূমি বরাদ্দ প্রদানে সিএস, আরএস, বিএস জরিপের দলিল ও রেকর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। নদীর জমির ক্ষেত্রে দিয়াড়া জরিপ এবং সিএস খতিয়ান ব্যবহার হবে। বালুচরই প্রমাণ করে— এ জমি বুড়িগঙ্গা নদীর। নাব্য হ্রাসের কারণে জেগে ওঠা বুড়িগঙ্গার জমি, যা ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের আইনানুগ ভিত্তি নেই। ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং কালেক্টর কার্যালয় থেকে ৩৩টি ডকইয়ার্ডের নামে জমি বন্দোবস্ত বা নামজারির রেকর্ড পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা প্রশাসন যৌথভাবে মোবাইল কোর্টসহ সকল আইন প্রয়োগ করে ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবে। দিয়াড়া জরিপের মাধ্যমে নদীর সীমা চিহ্নিত করে স্থায়ী পিলার স্থাপন করবে। ডকইয়ার্ডের মালিকানা, ডিসিআর প্রদান, বিভিন্ন দপ্তরের সার্টিফিকেট প্রদান, অনাপত্তি প্রদানের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। সুপারিশে আরও বলা হয়— বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌ-যান চলাচল নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে ডকইয়ার্ডগুলো অন্যত্র সরানো দরকার। ডকইয়ার্ড মালিকদের বৈধ ভূমি থাকলে অধিগ্রহণের প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। ডকইয়ার্ড ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। নদীতীর, পানি, পরিবেশ ও জনস্বার্থের ক্ষতি করে না— এমন সুবিধাজনক স্থানে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করে একটি ডকইয়ার্ড জোন স্থাপনের সুপারিশ করে কমিটি। এজন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে প্রয়োজনানুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে ডকইয়ার্ড জোন নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে। উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গা নদী ও তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। নদীর সব জায়গা উদ্ধারের পর সীমানা খুঁটি বসানো হবে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরীতীরের উদ্ধার করা জায়গায় ৫০ কিলোমিটার হঁঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) ও সবুজ চত্বর তৈরি করা হবে।নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, বুড়িগঙ্গা নদী ও তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে চলমান প্রক্রিয়ায় ডকইয়ার্ডগুলো বিষয়ে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনসহ সবকিছু বিবেচনায় এনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আজ নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ আমার সংবাদকে বলেন, নৌ-যানের সুরক্ষায় ডকইয়ার্ডগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এগুলোর বর্জ্য নদীকে ভিষণভাবে দূষণ এবং নৌ চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে, তাই সরনো হবে। সরানোর জন্য মালিকদের সময়ও দেওয়া হবে। এর মধ্যে তারা ডকইয়ার্ডগুলো সরিয়ে নেবে এবং নদী রক্ষায় আমাদের সহায়তা করবে বলে আশাকরি।