Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

খেলোয়াড় আছে, খেলার সুযোগ নেই

প্রিন্ট সংস্করণ॥আনোয়ার হোসেন

এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০৭:০৫ পিএম


খেলোয়াড় আছে, খেলার সুযোগ নেই

বিশ্বের এক নম্বর খেলা ফুটবল হলেও বাংলাদেশে এখন দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। তবে সত্তর-আশির দশকে এই ফুটবলের উপরই ভর করে কোনোরকম টিকে ছিল ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলা। সেসময় খেলোয়াড়দের জন্য ছিল মাঠে খেলার সুযোগ, কিন্তু খেলোয়াড়ের তখন ছিল অভাব। বর্তমানে দেশে খেলোয়াড়ের অভাব নেই, তবে নেই তাদের খেলার সুযোগ! ফলে, দারুণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অকালে ঝরে পড়ছে কিশোর ও যুব খেলোয়াড়রা! এটা কেবল ফুটবলের বেলায়া-ই নয়- ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স, ভলিবলসহ আরো অনেক খেলায়ই নিজেদের পারফর্ম প্রদর্শন করার আগেই নানা কারণে কিশোর বয়সেই খেলোয়াড়রা খেলাধুলায় আগ্রহ হারায়। দেশে এখন প্রায় অর্ধশত ক্রীড়া ফেডারেশন রয়েছে। থাকলেও হাতে গোনা কিছু ফেডারেশন বছরে দায়সারাভাবে খেলোয়াড় বাছাই কর্মসূচি চালু করলেও পরবর্তিতে সেটা বিভিন্ন কারণে আলোর মুখে দেখে না। এতে খেলোয়াড়রা হচ্ছে প্রতারিত-নিরুদশাহী। সরেজমিন বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন, ক্লাব, ফুটবল-ক্রিকেট একাডেমি ও খেলার মাঠ পরিদর্শন করে দেখা গেছে, দেশে নবীন ও আগ্রহী খেলোয়াড়ের অভাব নেই- কিন্তু তাদের অনেকেরই দারুণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও লিগে খেলতে না পরার কষ্ঠ ও আক্ষেপ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে এবারো। দুঃখের বিষয় এই যে, ক্লাব কর্মকর্তা, কোচ, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজনপ্রীতির কাছে যেন অসহায় হয়ে পড়েছে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়রা। ফলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে দেখা দিয়েছে মানসম্পন্ন খেলোয়াড়ের অভাব। আর এর জন্য কী দায় এড়াতে পারবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ অন্যান্য ফেডারেশন ও ঢাকা মহানগরী ফুটবল লিগ কমিটি? এদিকে, ১৭ শতকের শেষের দিকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফুটবল খেলা চালু হয় এই উপমহাদেশে। ক্রমে সেটি হয়ে উঠেছিল উপমহাদেশের প্রধান খেলা। স্থানীয় ক্লাবের জনপ্রিয়তাও ছিল তুমুল, ফুটবল নিয়ে গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস, সিনেমা আর রম্য রচনাও রচিত হয়েছে এ দেশে। এখনো প্রতি চার বছর অন্তর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়, সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও দেখা যায় ফুটবল উন্মাদনা। কিন্তু ঘরোয়া ফুটবলের বেলায় গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে আগ্রহী নয় ফুটবলপ্রেমীরা। এর কারণ দেশে এখন মানসম্পন্ন ফুটবলারের অভাব। তাই মাঠে টানে না দর্শকদের। রাজধানীতে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, পাইওনিয়ার, তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগগুলো সংশ্লিষ্ঠ ক্রীড়া ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা অযোগ্যতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সময়মতো মাঠে না গড়ানো, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে লিগ বা টুর্নামেন্ট না হওয়া, খেলোয়াড়দের জন্য নেই তেমন কোনো ভালো একাডেমি বা বিনা পয়সায় ট্রেনিংয়ের সু-ব্যবস্থা, নেই কোনো খেলোয়াড়দের জন্য কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা, যে কটি ব্যক্তি মালিকানাধীন একাডেমি বা ট্রেনিং সেন্টার আছে সেগুলো আবার যেমন ব্যয়বহুল তেমনি গ্যারান্টিহীনও। যার ফলে, সাধারণ ও দরিদ্র পরিবার তাদের ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এদিকে, দেশে মানসম্পন্ন ফুটবলারের অভাব আছে বলে মনে করেন না দেশের ফুটবল বোদ্ধা ও সংশ্লিষ্ঠরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনই (বাফুফে) পারে তরুণ ও সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের খেলার সুযোগ তৈরি করে দিতে। কিন্তু সেটা তারা করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এর দায় বাফুফেরই। যদিও সম্প্রতি বাফুফের তত্ত্বাবধানে সারা দেশ থেকে বাছাই করে কিশোর ফুটবলারদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে প্রসংশার পেয়েছে। তবে খবর নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ছিল না পুরোপুরি স্বচ্ছতা। স্বজনপ্রীতির কারণে বাদ পড়তে হয়েছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ ফুটবলারকে। ফুটবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে থাকেন, বাংলাদেশে ফুটবলের সেই সুদিন এখন আর নেই। নব্বই দশকের পর থেকেই এখানে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাবগুলো কতটা আকর্ষণ করতে পারছে নতুন তরুণ কিশোরদের? প্রতি বছর ক্লাবগুলোতে কি পরিমাণ ছেলেমেয়ে খেলতে আসে বা খেলা শিখতে আসে সেটার কোনো হিসাব নেই। চলতি বছরের মার্চ মাসের শুরুতে রাজধানীর গোপীবাগের দ্বিতীয় বিভাগের দল লিটিল ফ্রেন্ডস ক্লাবের খেলোয়াড় বাছাই পর্বের (ব্রাদার্স ইউনিয়ন মাঠ) প্রথম দিনে আড়ই’শ কিশোর যুবক ফুটবলার সারা দেশ থেকে অংশ নেয়! তারা সবাই ফুটবল খেলতে চায়। সেখান থেকে দলের জন্য কোচ ওয়াসিম বেছে নেন ৩২ জন ফুটবলার। খবর নিয়ে জানা গেছে, এবার দ্বিতীয় বিভাগের প্রতি দলের বাছাই পর্বের অনুশিলনেই আড়াই’শ থেকে তিন’শ ফুটবলার অংশ নেয়। জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও কোচ মো, ওয়াসিম আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, এবার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাছাই পর্বে আসা ফুটবলারদের সবাই ফুটবল খেলতে ভিষণভাবে আগ্রহী দেখা গেছে। কিন্তু তারা লিগে খেলার মতো নিজেকে তৈরি করতে পারেনি এখনো। তাদের বয়স ১৮ পেরিয়ে গেলেও দ্বিতীয় বিভাগে খেলেতে যে যোগ্যতা প্রয়োজন সেটা এখনো অর্জন করতে পারে নি। তাদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছে। অনেকেরই নেই পাইওনিয়র লিগে খেলার যোগ্যতাও। যারা কিছুটা শিখেছে তারাও পায়নি আধুনিক ফুটবলের শিক্ষা। এতে মনে হচ্ছে তারা আগে কখনো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো আধুনিক ট্রেনিংও পায়নি। এতে আমি ভিষণভাবে হতাশ হয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে কোচ ওয়াশিম বলেন, এর দায় অবশ্যই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উপরই পড়ে। এদিকে, আরামবাগ ফুটবল একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মো. রিয়াজ আহমেদ সানি আরাম সংবাদকে বলেন, ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে এটা ঠিক নয়, এখনো দলে দলে কিশোর ফুটবলাররা মাঠে আসে ফুটবলার হতে। কিন্তু আমরা তাদের তেমন একটা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারছি না। গত দুই বছর পাইওনিয়ার ফুটবল মাঠে গড়ায়নি। ফলে হাজার হাজার কিশোর সম্ভাবনাময় ফুটবলার সেশন জটে আটকে পরে দিশেহারা। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ওই ফুটবলার মানসিক দুশ্চিন্তায় পড়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতি মাসেই আরামবাগ ফুটবল একাডেমিতে দলে দলে এসে তারা সহযোগিতা চায় কোনো না কোনো ক্লাবে খেলতে। কিন্তু কজনকেই আমরা সহযোগিতা করতে পারবা ঢাকা মহানগরী ফুটবল লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগের সাধারণ সম্পাদক মহিদুর রহমান মিরাজ আমার সংবাদকে জানান, এটা সত্যি দেশে খেলোয়াড়ের অভাব নেই, কিন্তু তাদের সবাইকে আমরা খেলতে দিতে পারছি না। খেলার মাঠই তো নেই। দেখুন না, কমলাপুর স্টেডিয়ামেই ঘরোয়া লিগ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টও করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। রাজধানীতে যে কটি মাঠ আছে সেগুলোতে ক্রিকেট, ফুটবলসহ সব খেলাই এক সাথে চলছে। আসলে যারা ভালো মানের খেলোয়াড় তারা অনুশিলনটাই বা করবে কোথায়। এদিকে, বিশিষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক ও ঢাকা সিটি কপূোরেশনের (দক্ষিণ) ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাইদ আমার সংবাদকে জানান, আসলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলেই ফুটবলের আজ এমন পরিণতি। এটা ঠিক দেশে খেলোয়াড় আছে, কিন্তু তাদের খেলার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারছে না বাফুফে। আমি মনে করি, বাফুফে দেশের সর্বস্তরে ফুটবলটাকে ছড়িয়ে দিতে না পারা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে লিগ না হওয়াতে ফুটবলারদের মধ্যে একটা সেশন জট তৈরি হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ফুটবলেরই। সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, স্পন্সরবিহীন প্রিমিয়ার লিগসহ চ্যাম্পিয়নস লিগ, দ্বিতীয় বিভাগ লিগ চলছে। এখন দেখার অপেক্ষা পাইওনিয়ার ফুটবল ও তৃতীয় বিভাগ লিগ কবে মাঠে গড়ায়। এখন বাংলাদেশের ফুটবল যেন দেখার কেউ নেই।