প্রিন্ট সংস্করণ॥ফারুক আলম
অক্টোবর ৪, ২০১৯, ০৬:৩৪ পিএম
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কার্যালয় দুর্নীতি আর জনগণকে হয়রানির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ঘুষ না দিলে এখানে কোনো কাজ হয় না। দালাল পরিবেষ্টিত এ অফিসে দীর্ঘদিন ধরে থাকা কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের বিশ্বস্ত দলালচক্র তৈরি করেছেন তাদের কাছে জনগণ জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বিআরটিএর কার্যালয়গুলো। টাকা ছাড়া সেবা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই পুনরায় আগের অবস্থানে চলে আসে। আর বরাবরের মতো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। দালাল ছাড়া বিআরটিএতে কাজ করাই দুঃসাধ্য।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১০১টি খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে বিআরটিএকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নতুন কেউ কাগজ করাতে গেলেই তাকে গিয়ে ধরছে কয়েকজন। অল্প সময়ে কাগজ করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আদায় করে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
কাজল নামে এক গাড়ির মালিক জানান, তিনি দালালকে দিয়েই কাজ করাচ্ছেন। কারণ, ওখানে কেউই সহযোগিতা করেন না। অর্থ যেন সবার ধান্ধা। তার অভিজ্ঞতা হলো দালাল ধরলেই কাজটা আগে হবে। দালালদের সাথে কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকে। দালালেরা কর্মকর্তাদের নিয়মিত টাকা দিয়ে একটি সম্পর্ক করে রাখে, যাতে কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।
অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেন না আর কাজও করে দেন না। নানা অজুহাতে কাজ নিয়ে টালবাহানা করে থাকেন। কিন্তু দালালের কাছে দিলে ঠিকই কাজ করে দেন। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, ওই কর্মকর্তা টাকার জন্যই এসব করেছেন।
তৌহিদ হোসেন নামে এক গ্রাহক বলেন, তিনি গিয়ে গেট থেকে ঢোকার সাথে সাথেই তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়, বিআরটিএতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে দুই তিন হাজার টাকা বেশি দিলেই তার কাগজ হয়ে যাবে। এ জন্য তাকে মাত্র আধা ঘণ্টা বসতে হবে।
তিনি জানান, এক হাজার ৩০০ সিসির গাড়ির জন্য বিআরটিএকে দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা। এক হাজার ৫০০ সিসির গাড়ির জন্য দিতে হয় ২৩ হাজার টাকা। এর চেয়ে দুই-তিন হাজার টাকা বেশি দিলেই দালালেরা আধা ঘণ্টার মধ্যে কাগজ এনে দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের সেটেলমেন্ট, রেজিস্ট্রি ও ভূমি অফিসের মতো বিআরটিএ অফিসও দুর্নীতির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে স্পর্শকাতর বিআরটিএ কার্যালয়ে দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্য ‘ওপেন সিক্রেট’। দীর্ঘদিন ধরে এ অফিসটি দালালে ভরা। ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন নম্বর নবায়নহ যেকোনো কাজ করতে গেলেই তাদের খপ্পরে পড়তে হয়।
অর্থের বিনিময়ে অচল গাড়ির মালিককে ট্যাক্সটোকেন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়। এসব গাড়ি পরিবেশ দুষণ করছে এবং দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়োজিত দালাল জনগণকে তাদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করে। এরাই টাকার বিনিময়ে পরীক্ষামূলক ও স্থায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দয়ে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক কর্মচারী বলেন, এসব দালাল মূল্যবান ফাইলপত্রে অবাধে হাত দিয়ে থাকে। জনগণ কোনো কাজে অফিসে এলে তারা তাদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করে। তাদের খুশি করতে পারলেই ড্রাইভিং না জানা ব্যক্তিও লাইসেন্স পেয়ে থাকেন।
বিদেশ থেকে চোরাই পথে আসা ১৫৩ সিসির অধিক মোটরসাইকেল ও কাটা চেসিস দিয়ে তৈরি গাড়ি এবং ভুয়া চেসিস ইঞ্জিন নম্বরে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। টাকা দিলেই চলাচলের অযোগ্য গাড়ির মালিককে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়ে থাকে। সঠিকভাবে তদন্ত করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। এ অফিসে ভালো নম্বর বিক্রির ব্যবসাও জমজমাট। একজনের নম্বর অন্যজনকে দেয়ার রেকর্ডও রয়েছে।
দালালদের আদায় করা টাকা সহকারী পরিচালক (এডি). পরিদর্শকসহ প্রায় সব কর্মকর্তার মাঝে ভাগবাটোয়ারা হয়। ইদানীং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বেশি হওয়ায় কর্মকর্তারা সরিসরি টাকা গ্রহণ করেন না। এ জন্য দালালদের দিয়ে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেন। এভাবে দুর্নীতিবাজরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও সরকার মোটা অংকের রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘দালালচক্র ধরতে গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএর অফিসে আরও দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও লাইসেন্স করতে এসে কর্মকর্তারা কোনো কৌশলে একজন গ্রাহককে যেন হয়রানি ও ভোগান্তিতে ফেলতে না পারেন, সেটি কর্মকর্তাদের বলে দেয়া হবে।’
এমএআই