Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

খুঁড়িয়ে চলছে বেনাপোল স্থলবন্দর

প্রিন্ট সংস্করণ॥শাহ আলম খান

অক্টোবর ২৩, ২০১৯, ০৬:৪৬ পিএম


খুঁড়িয়ে চলছে বেনাপোল স্থলবন্দর জোড়াতালি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের প্রধান ও ব্যস্ততম বেনাপোল স্থলবন্দরের সার্বিক আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। সীমান্তবর্তী এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা বাণিজ্য হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ পণ্যও এ পথে আদান-প্রদান হয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও এ বন্দরের আমূল সংস্কার, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বড়পরিসরে কোনো ত্বরিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যেসব উন্নয়ন পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে তার বেশিরভাগই হয় আংশিক অথবা বিচ্ছিন্ন। যার বাস্তবায়নেও ছিল কচ্ছ্বপগতি। ফলে সুফল ভোগের আগেই ওই উন্নয়ন কার্যকারিতা হারিয়েছে। আবার কম খরচে ও কম সময়ে বাণিজ্য করা যায় বলে এ পথে ব্যবসায়ীদের চাপও আগের চেয়ে বেড়েছে। এতে স্থলবন্দরের সক্ষমতা আরও কমেছে এবং পরিস্থিতি বেহাল হয়ে উঠেছে। যা ব্যবসায়ী মহলেই দুশ্চিন্তা ও ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, আর্থ-সামাজিক সব ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দও প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ (পাঁচ হাজার কোটি টাকা) প্রতিবছর এই বেনাপোল স্থলবন্দরই জোগান দিচ্ছে। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে- বিপুল পরিমাণ এই অর্থের জোগান সচল রাখা কিংবা ভবিষ্যতে রাজস্ব আয় আরও বাড়ানোর কৌশল হিসাবেও মাত্র কয়েকশ কোটি টাকার নিয়মিত বরাদ্দ বার্ষিক এডিপিতে রাখা হচ্ছে না। বাংলাদেশ স্থলবন্দর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় স্বল্প পরিসরে বিচ্ছিন্ন কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। তাও দীর্ঘমেয়াদি, যা বাস্তবায়িত হবে ২০২১-২০২৫ সাল নাগাদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- দুর্বল, নাজুক ও ভঙ্গুর অবকাঠামো নিয়েই আরও কয়েক বছর পথ চলতে হবে বোনাপোল স্থলবন্দরকে। এ পরিস্থিতিতে পণ্য খালাসে জটিলতার চিত্র এখানে নিত্যদিনের। বন্দরের পণ্য ধারণের ক্ষমতা ৪০ হাজার মেট্রিক টন হলেও মাসের বেশিরভাগ সময়েই খালাসের চাপ নিতে হচ্ছে ৬০-৮০ হাজার মেট্রিক টনের। শেডগুলোতে স্থান স্বল্পতা রয়েছে। অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট অকেজো। এতে খালাস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানিকারকরা বন্দর থেকে সময়মতো তাদের পণ্য খালাস করতে না পারায় বন্দরে সৃষ্টি হচ্ছে পণ্যজট। জায়গার অভাবে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে রাখতে হয় খোলা জায়গায়। একই কারণে অনেক আমদানি পণ্যও রাখা হয় কোনো আচ্ছাদন ছাড়াই। প্রতিদিন এই বন্দর দিয়ে অন্তত সাড়ে চার থেকে পাঁচশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। কিন্তু পণ্য পরীক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় খুলনা কিংবা ঢাকায় নিয়ে আমদানিকৃত পণ্য পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে সময় বেশি লাগায় বাড়তি দিনের জন্য বন্দরের চার্জও বেশি দিতে হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে এসব পণ্য ফেলে রাখায় অনেক সময় মানও নষ্ট হচ্ছে অথবা পচে যাচ্ছে। এতে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যবসায়ীদের। যার প্রভাব পড়ছে উৎপাদিত পণ্যের সাধারণ ক্রেতা পর্যায়েও। জানতে চাইলে পণ্য খালাসে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কথা স্বীকার করে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, এটি দেশের প্রধানতম স্থলবন্দর হলেও হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি খুবই দুর্বল এবং ইক্যুইপমেন্টও ছোট। এ কারণে অগ্রাধিকার এবং পচনশীল পণ্যকে আগে খালাসের উদ্যোগ নিতে হয়। এর বাইরে রেফার্ড কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি হওয়া গুঁড়ো দুধ, বাটার বা কসমেটিকস ও ইলেক্ট্রিক-ইলেক্ট্রনিক্স আইটেমসহ মোট ৫৫টি পণ্য খালাসে বাধ্যতামূলক ল্যাব পরীক্ষার দরকার হয়। যা শেষ করতে মাসাধিককাল লেগে যায়। এ কারণে খালাসের প্রক্রিয়ায়ও অনেক সময় দীর্ঘ হয়। তবে এর জন্য কাস্টম হাউসের কোনো দায় নেই। ছাড়পত্র পেলে কাস্টম হাউস থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। পণ্য পরীক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, এ সমস্যা নিরসনে ইতোমধ্যে বিএসটিআই ও বিসিএসআইআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এরপর এনবিআর চেয়ারম্যানের অনুরোধে এখানে বিএসটিআইয়ের একটি শাখা অফিস চালু হলেও সেটি নামমাত্র। ল্যাব চালু হয়নি। জনবলও প্রায়শই থাকে না। পরীক্ষণের সমস্যা কেটে গেলে এবং বন্দরের সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানো হলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্য ও সরকারের রাজস্বও অনেক বেড়ে যেত। জানা গেছে, বাংলাদেশে আমদানিকৃত প্রায় সব পণ্যই বোনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে খালাস হয়ে থাকে। ফলে প্রতিবছর এ পথে বাণিজ্যের আকারও বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩২৯ মেট্রিক টন পন্য আমদানি করা হয়। আর একই সময়ে রপ্তানি করা হয় যথাক্রমে চার লাখ এক হাজার ১৭৭ মেট্রিক টন, তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন এবং তিন লাখ ২৫ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন পণ্য। সময় কম লাগায় নেসলে, ইউনিলিভারের মতো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এ বন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষণ জটিলতা এবং পর্যাপ্ত শেড ফ্যাসিলিটিজ না থাকায় তাদের বেশি অর্থ খরচ করে চট্টগ্রাম বন্দরই ব্যবহার করতে হচ্ছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান এ প্রসঙ্গে বলেন, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ল্যাব সমস্যা এবং পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট না থাকা- এ বন্দরের প্রধান সমস্যা। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যকারী দেশ। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া দৈনন্দিন জীবন-যাপনে প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যই ভারত থেকে আমদানি হয়। সেখানে এক ঘণ্টা বাঁচানো মানে অনেক অর্থের অপচয় রোধ হয়। এতে পণ্যের দামও কম থাকে। এর বিপরীতে বাড়ে। এ অবস্থায় ব্যবসা সূচকে খরচ কমানো ও অবকাঠামো ফ্যাসিলিটিজ বাড়ানোর বিষয়ে ডব্লিউটিওর কাছে বাংলাদেশের অঙ্গীকার আছে। তা বাস্তবায়িত হলেই বেনাপোল স্থলবন্দরের চিত্র পাল্টে যাবে। কিন্তু এর জন্য অগ্রাধিকার উন্নয়ন প্রকল্প থাকতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) গত বছর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান মন্তব্য করে বলেছেন, এখানে অপর্যাপ্ত ভূমি, সরঞ্জাম স্বল্পতা, লোকবলের অভাব এবং সেবার নিম্নমানের কারণে এসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে তিনি বন্দর সংলগ্ন এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ করে অপারেটিং আকার বাড়ানো, বিদ্যমান সক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার এবং উন্নয়ন ও সংস্কারে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করেন। বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য পরীক্ষাগার স্থাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মান উইংয়ের পরিচালক মো. সাজ্জাদুল বারী বলেন, স্বল্প পরিসরে সেখানে এখন বিএসটিআইএর একটি শাখা অফিস খোলা হয়েছে। কিন্তু এখনো পণ্য পরীক্ষণের কোনো ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়নি। এর জন্য অনেক সময় ব্যয় হয় স্বীকার করে তিনি বলেন, এ দুর্ভোগ লাঘবে যশোরে বিএসটিআইএর শাখা অফিস ও ল্যাব স্থাপনের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে বেনাপোল বন্দরে বিএসটিআইএর ল্যাব স্থাপনের পরিকল্পনা আপাতত নেই। এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয় বলেও দাবি করেন তিনি। ভবিষ্যৎ প্রকল্প : এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, ২৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এছাড়া ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন মেয়াদে বেনাপোল স্থলবন্দরে পার্কিং ইয়ার্ড, ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড ও অফিস বিল্ডিংসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সকল বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও আধুনিকীকরণ করা হবে। এক নজরে স্থলবন্দরের অবকাঠামো সুবিধা : ৩২টি ওয়্যার হাউজ, পাঁচটি ওয়্যার হাইস কাম-ইয়ার্ড, দুটি ওপেন স্টেক ইয়ার্ড, একটি ট্রান্সশিপমেন্টট ইয়ার্ড, পাঁচটি ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, দুটি ট্রাক টার্মিনাল, একটি আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ও আন্তর্জাতিক বাসটার্মিনাল, চারটি স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার জেনারেটর, একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট, দুটি ওয়াটার রিজার্ভার, একটি প্রশাসনিক ভবন, দুটি অফিস ভবন ও একটি রেস্ট হাউসসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো রয়েছে। বন্দরের ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার মেট্রিক টন। হ্যান্ডলিং শ্রমিক আছে দুই হাজার জন। এসটিএমএ